মহামারী করোনার দুঃসহ মাস এপ্রিল পার করেছে বাংলাদেশ। এপ্রিলে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ৬১৬ জন। মাসটিতে ১৬৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অথচ বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ওই মাসে মোট ৫১ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়, পাশাপাশি মৃত্যুবরণ করে ৫ জন। আর মে মাস মাত্র শুরু হয়েছে। প্রথম দুই দিনেই করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১২৩ জন। আর এ নিয়ে এ পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ৭৯০ জন। মে’র প্রথম দুই দিনে দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন ৭ জন। আর এ নিয়ে এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দাড়ালো ১৭৫ জনে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিদিনই বাড়ছে শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন শনাক্ত হয়েছে ৫৫২ জন এবং ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর তাই মে মাসে করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা নিয়েই চলছে বিশ্লেষণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষা আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে এখনো প্রতিদিন যে হারে পরীক্ষা হচ্ছে সেটাও যথেষ্ট নয়। এটা পুরো দেশের চিত্রও নয়। এখনও দেশ সংক্রমণের চূড়ায় নয়। পরীক্ষা সংখ্যা বাড়ালে এবং সাধারণ ছুটি শিথিল করে আনা হলে মে মাসে অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, রোগীর সংখ্যা যখন ক্রমাগত বাড়ছে। এখন দেশের সাধারণ ছুটি তুলে নিয়ে পোশাক কারখানা, দূরপাল্লার ট্রেন চলাচলের ভাবনা, রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, লকডাউন তুলে নেওয়ার ধাপ না মানা হলে চীন, ফ্রান্স, ইতালী ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় মূল্য দিতে হতে পারে আমাদের। এত উদাহরণ থাকা সত্তে¡ও লকডাউনের বিষয়ে যদি উদাসীনতা দেখানো হয়, তাহলে তার মূল্য কত বেশি দিতে হবে সেটা বলা মুশকিল এবং নিশ্চয়ই সেটা শঙ্কার বিষয়।
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ২০ মে পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য কঠিন সময়। তাই ভীষণ সতর্কতা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে পার করতে হবে। যদি সেটা না হয় তাহলে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু ও রোগী দুটোই দেখা যাবে মে মাসে।
সূত্র মতে, ৩ মে ভারতের লকডাউন তুলে নেয়ার কথা ছিল। পহেলা মে জরুরী বৈঠক করে লকডাউন ১৭ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শ্রীলংকা ও আয়ারল্যান্ড লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়েছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন লকডাউন তুলে দেয়ার সাহস পাচ্ছেন না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হম্বিতম্বি করলেও লকডাউন তুলে দেয়ার সাহস দেখাচ্ছেন না। ইন্দোনেশিয়া গণপরিবহন আরো কিছুদিন বন্ধ রাখার কথা জানিয়ে দিয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সেরে উঠলেও রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এখনো করোনায় আক্রান্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, তাড়াহুড়ো করে লকডাউন তুলে নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ৭৯০ জন। ইতোমধ্যে ৫জন পুলিশ, দুজন সাংবাদিক এবং কয়েকজন ডাক্তারসহ প্রাণ হারিয়েছেন পৌনে দুইশ মানুষ। আইন শৃখলা বাহিনীর ৮ শতাধিক সদস্য, ১৭ কারারক্ষি, সংসদ ভবনে দায়িত্বপালনরত আনছার, ৫৪০ জন ডাক্তার, ৩৩৪জন নার্সসহ ১২শ’র অধিক স্বাস্থ্যকর্মী, ৪০ সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত। নওগাঁ-২ আসনের সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকার করোনায় আক্রান্ত।
গার্মেন্টস অধ্যুষিত এলাকা সাভার, নারায়ণগঞ্জ, মিরপুর, গাজীপুর হট স্পট। ইতোমধ্যে হাজার গার্মেন্টস খুলে দেয়া হয়েছে। তবে শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। করোনার সংক্রমণের জন্য ঢাকা যেন এক আতঙ্কের নাম। রোগীদের ৮৪ শতাংশই ঢাকা বিভাগে। যার মধ্যে আবার প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি রাজধানীতে।
গতকালও করোনায় আক্রান্ত হয়ে যে ৫ জন রোগী মারা যাওয়ার তথ্য এসেছে তাদের সবাই ঢাকার বাসিন্দা। আর ঢাকায় অধিক পরিমানে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে- মানুষের নিয়ম-নীতি না মানার প্রবণতা। স্বাস্থ্য বিধি না মানা। পুলিশ রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো তদারকি করলেও অলিগলিতে অবাধে বিচরণ করছে মানুষ। এক্ষেত্রে প্রশাসনের লোকজন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেনা। দোকানপাট-বাজারে মানুষের অবাধে বিচরণ। কেউই মানছেনা স্বাস্থ্যবিধি।
সম্প্রতি আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, আগামী ৩১ মে পর্যন্ত ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন এবং মারা যেতে পারেন ৮০০ থেকে এক হাজার মানুষ। তার এই বক্তব্যেও ‘মে’ মাসের ভয়াবহতা উঠে এসেছে।
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে যেভাবে চলছে তা ধরে রেখে আগাতে পারলে মে মাসের শেষের দিকে দেশের করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি। তবে গার্মেন্টস ও দোকানপাট খোলায় এবং স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে না মানলে আরও বড় বিপদের মধ্যেও পড়তে পারি বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মেনে চলার আহবান জানান। তবে মে’ মাস আমাদের জন্য খুবই ভয়ংকর। যা আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার উপর নির্ভর করছে বলে উল্লেখ করেন ডা. এএসএম আলমগীর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, কোন হিসাবই মিলছে না। কারণ কোনকিছুই সঠিকভাবে হচ্ছে না। মানা হচ্ছে না লকডাউন এবং স্বাস্থ্যবিধি। আবার পরীক্ষার ক্ষেত্রেও সারাদেশের সঠিক চিত্র আসছে না। তাই কতদিন এভাবে থাকবে বা কমবে কিনা তা বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, কোন ক্যালকুলেশনই মিলছে না। এমনকি আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি আসছে কিনা তা বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে। আরও দু’দিন গেলে হয়তো বোঝা যেতে পারে। প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, বড় বিপদ অবশ্যই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কারণ গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হয়েছে। তার ফল আমরা পাবো ১২ মে’র দিকে। একই সঙ্গে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার জানাযার উপস্থিতির ফল হয়তো শিগগিরই পাবো।
এরপর বলা যাবে আরও কতদিন লকডাউন রাখা উচিত। তবে যে লকডাউন চলছে তাতে আসলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। তবে মে অবশ্যই আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর হবে বলেন প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম। চীনের উহানের চেয়ে ঢাকার অবস্থা খারাপ মনে হচ্ছে উল্লেখ করে বিশিষ্ট এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, মানুষ লকডাউন মানছে না। ঢাকা শহরের সংক্রমিত মানুষের হার এর সঙ্গে মেলালেই সেটা বোঝা যায়।
বর্তমানে যেভাবে রোগী প্রতিদিন রিপোর্ট হচ্ছে তাতে সংক্রমণটা নিয়ন্ত্রণে নেই মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক প্রফেসর বে-নজির আহমেদ বলেন, বর্তমানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ব্যবস্থা রয়েছে সেটা যথেষ্ট নয়। লকডাউন যদি ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হয় তাহলে সংক্রমণ বাড়বে এবং বাড়তেই থাকবে। পুরো মে মাসেই সংক্রমণ হতেই থাকবে।
তিনি বলেন, রোগী সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র এবং কার্যকর পন্থা ছিল কঠোর লকডাউন, সেটা ঢাকার বাইরে এবং ঢাকার ভেতরেও। লকডাউন এখনই তুলে নেওয়া ঠিক হবে না। একই সঙ্গে লকডাউন আরও কঠোর করতে হবে কিছু দিনের জন্য।