করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও সাধারণ ছুটি (লকডাউন) পালন করছে। করোনা পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ইতিবাচক রাখতেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গত ২৬ মার্চ। যদিও অনেকে মনে করেন, এই ধরনের ব্যবস্থাপত্র বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে খুব একটা কার্যকর নয়। আবার দেশের অনেক মানুষ সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ভাবে পালন করছেনা। এতে প্রতিদিনই বাড়ছে নতুন করে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। এমন পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঈদের কেনাকাটার জন্য দোকানপাট ১০ মে থেকে সীমিত আকারে খোলা রাখার। আর গতকাল ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার জোহরের ওয়াক্ত থেকে স্বাস্থ্যবিধি ও দূরত্ব রক্ষার নিয়মসহ কিছু শর্ত মেনে সুস্থ ব্যক্তিরা মসজিদগুলোতে জামাতে নামাজ পড়তে পারবেন। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে আগামী ৭-১০ দিন দেশের জন্য ভয়াবহ হবে। সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে।
তারা বলেন, কিছুদিন আগে গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হলো আর ১০ মে থেকে যদি দোকানপাট ও শপিং মলও খুলে দেওয়া হয়, তাহলে সে শঙ্কা আরও বহুগুণে বাড়বে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট আক্রান্ত ব্যক্তির প্রায় ৬০ শতাংশই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। আর তাই এই দুই এলাকার ব্যাপারে সাবধানতা আরও বেশি প্রয়োজন। চিন্তার বিষয় হলো বেশির ভাগ গার্মেন্টস কারখানাও এই দুই জেলায় ও গাজীপুরেই অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান বলছে, গতকাল তাদের আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখে। অথচ প্রথম ৫০ দিনে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজারের মতো। আর বাংলাদেশে প্রথম ৫০ দিনে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার। তাই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের দেশে শঙ্কা এখনো রয়েই গেছে।
করোনা সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির একজন সদস্য বলেন, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম রোগী সনাক্ত হয় এবং আমার গত ২৬ মার্চ থেকে ছুটি শুরু করেছিলাম। ছুটি মানে সবাই ঘরে থাকবে। কেউ ঘর থেকে বের হবে না। তাহলে রোগের বিস্তার ঘটবে না, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের (সামাজিক সংক্রমন) মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়বে না। কিন্তু এক শ্রেনীর লোক সেটি মানছে না। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এসব নির্দেশনা না মানার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এখন আমদের সনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এখন আবার গার্মেন্টসহ বিভিন্ন্ শিল্প কারখান খুলে দেয়া হচ্ছে, শপিং মল, মসজিদ খুলে দেয়া হচ্ছে। এসব আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের কারণে সংক্রমনের হার অনেক বাড়া স্বাভাবিক।
এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার বর্তমানে ঊর্ধমুখী। গত কয়েকদিনে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জে মানুষ যেভাবে লকডাউন অমান্য করেছে, আগামী ৭-১০ দিন দেশে সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। তাই প্রতিটি মুহুর্ত এখন মূল্যবান। বিশ্বের কোন দেশ সংক্রমণের এই পর্যায়ে লকডাউন শিথিল করা বা তুলে নেয়ার কথা চিন্তাও করেনি। একমাত্র সুইডেন করেছিল এবং মাত্র ২ সপ্তাহের মধ্যেই সেই ভুলের মাশুল তারা দেয়া শুরু করেছে। প্রতিদিন বাড়ছে তাদের মৃত্যু সংখ্যা। এখন তারা নিজেরাই নিজেরদের ভুলের জন্য অনুশোচনা করছে। লকডাউন শিথিল করার নামে যে কয়েকটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নিয়েছে, সেগুলো অবিলম্বে বাতিল করাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন তিনি।
এদিকে তৈরি পোশাক কারখানা খোলা ও দোকানপাটে আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শ কমিটির বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সংক্রমণ কিছু বেড়েছে। যেহেতু এখন স্বাভাবিকভাবেই মার্কেট খোলা হয়েছে (খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে), গার্মেন্ট খোলা হয়েছে, দোকানপাটে আনাগোনা বাড়ছে- কাজেই সংক্রমণ যে বৃদ্ধি পাবে, এটি আমরা ধরেই নিতে পারি। আমাদের যতটুকু সম্ভব এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশব্যাপী চলমান লকডাউন খোলার ব্যাপারে ১৭ সদস্যের বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত করোনা টেকনিক্যাল কমিটি সরকারকে পরামর্শ দেবে। একই সঙ্গে ঈদে শপিং মল, দোকানপাট বন্ধ রাখা হবে কিনা সে ব্যাপারেও কমিটি সরকারকে পরামর্শ প্রদান করবে। দেশের এ উচ্চ শ্রেণির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামত অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে সরকার। তারপর সরকারের যে নির্দেশনা থাকবে, সে অনুযায়ী কাজ করা হবে।
কিন্তু টেকনিক্যাল কমিটির এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেয়ার কোন এখতিয়ার নেই বলে জানান কমিটির অন্যতম সদস্য প্রফেসর ডা. এম ইকবাল আর্সলান। তিনি বলেন, টেকনিক্যাল কমিটির কার্যপরিধিতে এসব বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার কথা উল্লেখ নেই। এ পর্যন্ত লকডাউন শিথিল করার বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে লকডাউন শিথিল করতে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেগুলো একপ্রকার আত্মঘাতি।