ভারত ও বাংলাদেশ উপকূলের কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’। আজ বুধবার দুপুরে এই প্রতিবেদন লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল থেকে মাত্র আড়াই শ’ কিলোমিটার ব্যবধানে রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম ও সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব এবং পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগরে এর অবস্থান। ইতোমধ্যে ‘আমফান’ আবারো গতিপথ ও দিক পরিবর্তন করেছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি ভারত ও বাংলাদেশের উভয় অংশে সুন্দরবন অঞ্চল দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। বদলেছে আগের গতিপথ খুলনা-চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী উপকূল। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত শুরু বিকেলে।
ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং এর সংলগ্ন বাংলাদেশ উপকূলের কাছাকাছি এগিয়ে আসায় ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে ঘূর্ণিঝড়-জনিত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার আগাম প্রভাব। এই পরিপ্রেক্ষিতে আজ সকালে মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং এর সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১০ (দশ) নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত ঘোষণা করেছে আবহাওয়া বিভাগ।
এর কিছুক্ষণ পরই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৯ (নয়) নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার ও তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের আওতায় থাকবে।
ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ উপকূলে আঘাতের একই সময়ে অমাবস্যার সক্রিয় প্রভাব থাকবে। এতে করে স্বাভাবিক সামুদ্রিক জোয়ারের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতায় ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ছোবল হানার সতর্কতা দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। সংশ্লিষ্ট উপকূলীয় এলাকার জনগণের জানমাল সুরক্ষায় এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদে স্থানান্তরের লক্ষ্যে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে।
জেলা-উপজেলা মাঠ প্রশাসন, পুলিশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, কোস্ট গার্ড, র্যাব, বিজিবি, আনসার-ভিডিপি, রেডক্রিসেন্ট ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবকগণ বিভিন্ন এলাকায় তৎপর হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও গণভবন থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’র সর্বশেষ পরিস্থিতি, করণীয় সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। মনিটরিং করা হচ্ছে সার্বক্ষণিক। বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে আপডেট থাকছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সারাদেশের বিশেষত উপকূলীয় ২১টি জেলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান এবং উপকূলের দিকে ধেয়ে আসার সময়ে বিগত তিন দিনে তিন দফায় গতিপথ ও দিক পরিবর্তন করেছে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’। প্রথমে অগ্রসর হয় ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর, উত্তর-পশ্চিম দিকে। এরপর উত্তর। তারপর সর্বশেষ উত্তর, উত্তর-পূর্বমুখী।
এরফলে অবশেষে সরাসরি বাংলাদেশে আঘাত করছে না ‘আমফান’। সর্বশেষ গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী ‘আমফান’র আগের তুলনায় শক্তি কমে এসেছে। তা আরও কমতে পারে উপকূলে আছড়ে পড়ার সময়ে। তখন গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় স্থানভেদে ১৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১৬০। এমনকি ১৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত। সুন্দরবন-পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূলে প্রবেশের সময়ে কিংবা তারও আগে ২শ’ কিলোমিটার গতিবেগ থাকতে পারে। এ মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২শ’ থেকে ২২০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে ধাবিত হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূলের দিকে। সুপার সাইক্লোনের মাত্রায় থাকতে গত সোমবার ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ উঠে ঘণ্টায় ২৪৫ কি.মি. পর্যন্ত। সিডরের সমান শক্তি নিয়ে ‘আমফান’ আঘাতের মতো শঙ্কা দেখা যাচ্ছে না।
ঘূর্ণিঝড়টির আঘাত কমবেশি পড়তে পারে সাতক্ষীরা, খুলনা-বরিশাল অঞ্চলের একাংশ হয়ে বৃহত্তর নোয়াখালীর বিশেষত হাতিয়া দ্বীপাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমে যশোর, ঝিনাইদহ, মধ্যাঞ্চলে পাবনা, ময়মনসিংহ, উত্তরের জনপদ রংপুর ছাড়াও মধ্যবর্তী বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে। ‘আমফান’ দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের উপকূলে এবং বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালাতে পারে। তবে এ সময় জলোচ্ছ্বাসের ছোবলে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে ব্যাপক।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত, আবহাওয়া মানচিত্র, বাংলাদেশ ও ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের সতর্কতা বুলেটিন সূত্রে এই পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। এদিকে কিছুক্ষণ আগেই আবহাওয়া বিভাগ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৬ নম্বরের পরিবর্তে নয় নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত ঘোষণা করলো। ‘আমফান’র আঘাতের মূল ঝুঁকির এলাকায় পড়লো চট্টগ্রামও। বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামবাসীর দুশ্চিন্তা, অজানা শঙ্কা-ভীতি বেড়ে গেলো।
দশ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত-
ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’র সর্বশেষ অবস্থান ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আজ দুপুরে আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আজ দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৭০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৯০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৩২০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
এটি আরও উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আজ বুধবার বিকেল অথবা সন্ধ্যায় সুন্দরবনের নিকট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূল অতিμম করতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ২০০ কি.মি., যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের এলাকায় বঙ্গোপসাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে।
মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ১০ (দশ) নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ (নয়) নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
ঘূর্ণিঝড় জনিত জলোচ্ছ্বাসের সতর্কতা-
ঘূর্ণিঝড় এবং দ্বিতীয় পক্ষের চাঁদের সময়ের শেষ দিনের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ঝড়ো হাওয়ার সতর্কতা-
ঘূর্ণিঝড় অতিμমকালে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলা সমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘন্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কি.মি. বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতিসত্ত্বর নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
করোনা মহামারী পরিস্থিতির মাঝেই হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’র মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি উপকূলের লাখ লাখ মানুষের মাঝে উদ্বেগ-ভীতি। সর্বত্র নানামুখী সীমাহীন জনদুর্ভোগ। নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হচ্ছে জোরালোর সাথে। আবার এ বিষয়টির সাথে করোনা সংক্রমণের উচ্চঝুঁকিও রয়েছে। উপকূলজুড়ে ঝড়-পূর্ব থমথমে গুমোট আবহাওয়া বিরাজ করছে। দমকা হ্ওয়ার সঙ্গে কোথাও কোথাও থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ স্থানে আকাশ মেঘলা।
আবার অনেক জায়গায় এখনও পড়েনি ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ প্রভাব। তাপমাত্রা রয়েছে কমতির দিকে। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে এবং পরবর্তী সময়ে দেশের অধিকাংশ বৃষ্টি-বজ্রবৃষ্টির আভাস দেয়া হয়েছে।