৫০ লাখ পরিবারকে বিশেষ প্রণোদনা ২ হাজার ৫০০ টাকা করে সহায়তা কার্যক্রমে তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ এবার ত্রাণের চাল-ডাল-গমের বদলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ত্রাণের টাকা চুরি করছেন। মানুষের অজান্তেই মোবাইল একাউন্টের মাধ্যমে গরিবের টাকা মেরে দিচ্ছেন। এলাকার বিভিন্ন জনের নাম তালিকায় দিয়ে নিজের এবং নিজস্ব ব্যাক্তির মোবাইল নম্বর জুড়ে দিচ্ছেন। এতে প্রণোদনা তালিকাভুক্ত ব্যাক্তিদের টাকা তার (নেতা) মোবাইল চলে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা তালিকায় তিনশ জনের নামের সঙ্গে ৪টি নম্বর, ৯৯ জনের নামের সঙ্গে একটি নম্বর, ৯৭ জন, ৬৫ জন ও ৪৫ জনের নামের সঙ্গে একটি নম্বর দিয়ে প্রণোদনার অর্থ নেয়া হয়েছে। করোনার এই দুর্যোগকালে ডিজিটাল জালিয়াতি করে কর্মহীন বিপন্ন মানুষের খোরাক কেড়ে খাওয়া জনপ্রতিনিধি এবং তাদের দোসর, নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে। শুধু তাই নয় প্রধানমন্ত্রী দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি পেশার বিপন্ন মানুষের তালিকা প্রণয়নের নির্দেশনা দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তালিকা প্রণয়নে দলীয়করণ করা হয়েছে। যদিও প্রশাসন থেকে দাবি করা হচ্ছে নতুন করে অনিয়ম দুর্নীতির নজরে আসায় নতুন করে তালিকা প্রণয়ন এবং সংশোধন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হবিগঞ্জ, সুমানগঞ্জ, মেহেরপুর, লালমনিরহাট, নাটোর সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষিরা, বাগেরহাট, পাবনা, জামালপুর, কুষ্টিয়াসহ কয়েকটি জেলায় ছলচাতুরি করে তালিকায় ‘বিশেষ মোবাইল নম্বর’ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার টাকা তসরুপ করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় সরকারি দলের জনপ্রতিনিধি এবং নেতাদের চাপে অসহায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। একইসঙ্গে প্রকাশ পায় সরকারের করোনা কর্মসূচির ১০ টাকার ওএমএস চালে দুর্নীতি।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ছাড়াও জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, শিক্ষক ও সমাজের মুরুব্বিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি তালিকা তৈরি করেছে। তারপরও বেশ কিছু ত্রুটি ধরা পড়ছে। অন্ধের মতো ওই তালিকা অনুযায়ী টাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়নি। কেউ কেউ অনিয়ম করার চেষ্টা করেছে। কয়েকজন জনপ্রতিনিধি একাধিক নামের বিপরীতে একটি মোবাইল নম্বর দিয়েছে। সেই তালিকা বাতিল করে ব্যাংকের মাধ্যমে নগদ টাকা চলে যাবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এমনভাবে ত্রাণের টাকা লুটে নেয়া অমানবিক, অনৈতিক। সরকারের উচিত ত্রাণ চোরদের কঠোর বিচার করা। ১৪ মে ৫০ লাখ পরিবারের প্রণোদনা সহায়তার প্যাকেজ উদ্বোধনের পরই বিভিন্ন এলাকার তালিকায় অনিয়ম, একই মোবাইল নম্বর দিয়ে অনেক মানুষকে তালিকাভুক্তির মতো ঘটনা মিডিয়ায় উঠে আসতে শুরু করে। এছাড়া ভিন্নমতের কারণে কাউকে কাউকে বাদ দিয়ে স্বচ্ছল ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সুবিধা পাওয়া মানুষের নামও এই তালিকায় নেয়ার চিত্র আসে। তালিকায় অনিয়ম করায় জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঘটনাও ঘটে। বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম তদন্তে স্থানীয় প্রশাসন তদন্ত করছে।
অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকাতে সরকার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহায়তার অর্থ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জালিয়াতির করেছে। হবিগঞ্জের লাখাইয়ের মুড়িয়াউক ইউনিয়নে তিনশ নামের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে ৪টি মোবাইল ফোন নম্বর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেহেরপুর গাংনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের পরাজিত এক প্রার্থী ইনকিলাবকে বলেন, আমাকে ভোট দেয়ার কারণে আমার এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের তালিকা নাম দেয়া হচ্ছে না। ।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, নগদ টাকা ও চাল নিয়ে যত অভিযোগ এসেছে আমরা প্রত্যেকটির তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছি। ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, তালিকায় ভুলের পরিমাণ কম করে হলেও ৩০ শতাংশ। পরে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করে তাতে ব্যাপক সংশোধন করে চূড়ান্ত তালিকা জমা দেয়া হয়। নওগাঁ জেলা প্রশাসক হারুন-উর রশিদ বলেন, জেলায় এই তালিকা বাছাইয়ে প্রতি গ্রামে তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারী যেমন তহসিলদার, ইউনিয়ন বোর্ডের কর্মচারীদের কাজে লাগিয়েছেন এবং ভালো ফল পেয়েছেন।
জামালপুর জেলা প্রশাসক এনামুল হক বলেন, জামালপুর গরিব ও নদীভাঙন জেলায় এক লাখ লোকের তালিকা করা হয়েছে। এখানে কেউ কোনোভাবে প্রভাব খাটাতে পারেনি।
হবিগঞ্জে ৩০০ নামের বিপরীতে ৪ ফোন নম্বর : তালিকা তৈরিতে হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মুড়িয়াউক ইউনিয়নে তিনশ জনের নামের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র ৪টি মোবাইল ফোন নম্বর। এই ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডে হিন্দু স্প্রদায়ের কোনো পরিবার বাস না করলেও তালিকায় ৩ জনের নাম জুড়ে দেয়া হয়। একই পরিবারের ৬ সদস্য এবং বিত্তশালী অনেক পরিবারের সদস্যদের নামও উঠেছে তালিকায়। মুড়িয়াউক ইউনিয়নের তালিকায় ৯৯ জনের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে ০১৯৪৪৬০৫১৯৩ মোবাইল ফোন নম্বরটি। ৯৭ জনের নামের সাথে মোবাইল ফোন নম্বর দেয়া হয়েছে ০১৭৪৪১৪৯২৩৪। আর ৬৫ জনের বিপরীতে ০১৭৮৬৩৭৪৩৯১ এবং ৪৫ জনের বিপরীতে মোবাইল নম্বর দেয়া হয় ০১৭৬৬৩৮০২৮৪। তালিকায় একই পরিবারের ৬ জন সদস্যও রয়েছেন। একটি ওয়ার্ডে হিন্দু জনবসতি না থাকলেও তালিকায় ৩ হিন্দু ব্যক্তির নাম জুড়ে দেয়া হয়েছে। শুধু মুড়িয়াউকই নয়, উপজেলার ৬টি ইউনিয়নেই একই ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এমনকি দুইশ’ ব্যক্তির বিপরীতে একটি মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মচারী।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে লাখাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, এই অনিয়মগুলো তদন্ত চলছে।
হবিগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, তালিকাতে ত্রুটি থাকায় সংশোধন করা হয়েছে। একই মোবাইল নম্বরে কোনো অবস্থাতেই একাধিক ব্যক্তিকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করা হবে না।
বাগেরহাটের শরণখোলায় একই কান্ড ঘটিয়েছেন এক ইউপি সদস্য। ৪০ জন মানুষের নামের পাশে নিজের মোবাইল নম্বর জুড়ে দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয় শরণখোলা উপজেলার ওই তালিকায় চৌকিদার, সরকারি বিভিন্ন সুবিধাভোগকারী ও স্বচ্ছল ব্যক্তির নামও রয়েছে। ৪০ জন সুবিধাভোগীর নামের তালিকায় নিজের মোবাইল নম্বর জুড়ে দেয়া ইউপি সদস্য হচ্ছেন শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রাকিব হাসান।
লালমনিরহাটে ৫৩ দুস্থের এক নম্বর : আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলালউদ্দিন আলালের পিএস ছমির উদ্দিনের মোবাইল ফোন নম্বরটি প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দের তালিকায় ৫৩ জন দুস্থের নামের পাশে ব্যবহার করা হয়েছে। তালিকায় মৃত ব্যক্তির নামও রয়েছে। অথচ বিএনপি করায় অনেকের নাম দেয়া হয়নি।
আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মনসুরউদ্দিন বলেন, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের প্রতিটিতেই একশ থেকে দেড়শ নাম গোঁজামিল দিয়ে তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় একই লোকের মোবাইল ফোন একাধিক নামে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও সহায়তার এই তালিকা নিয়ে উপজেলার পলাশী, সারপুকুর ইউনিয়ন এবং জেলা সদরের হারাটি ইউনিয়নে অভিযোগ উঠেছে। বিএনরি রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও লালমনিরহাট জেলার সাবেক প্রতিমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু জানান, তালিকায় দলীয়করণ করা হয়েছে। বিএনপি পন্থীদের নাম তালিকায় দেয়া হয়নি।