করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে লকডাউন দেয়া নিয়ে বিভ্রান্তি চলছে। সরকারি ওয়েবসাইটে ৫০টি জেলা ও ৪০০টি উপজেলাকে পুরোপুরি লকডাউন (রেড জোন বিবেচিত) দেখানো হয়েছে। আংশিক লকডাউন (ইয়েলো জোন বিবেচিত) দেখানো হয়ে পাঁচটি বিভাগ, ১৩টি জেলা ও ১৯টি উপজেলাকে। আর লকডাউন নয় (গ্রিন জোন বিবেচিত) এমন জেলা দেখানো হয়েছে একটি এবং উপজেলা রয়েছে ৭৫টি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গত শনিবার (৬ জুন) সর্বশেষ আপডেট করা তালিকায় এসব ছাড়াও ঢাকা মহানগরীর আংশিক লকডাউন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে ৩৮টি এলাকাকে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ওয়েবসাইটটি হালনাগাদ না করায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে, মহামারীর সময় নির্ভুল তথ্যপ্রবাহ অন্য সব কিছুর মতই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, মহামারির সময় মানুষ খাদ্য এবং সঠিক তথ্য ছাড়া আর কিছুই চায় না। এ দুটো পেলেই মানুষ অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারে। এটা যদি মানুষকে ঠিকভাবে জানানো না হয়, দেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। এলাকাভিত্তিক বিধিনিষেধ আরোপের প্রস্তাব এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে জোন যাই হোক মাস্ক পড়া ও সামাজিক দূরত্ব মানা বাধ্যতামূলক থাকছে সবখানেই। আইইডিসিআর সূত্রে জানা গেছে, পরীক্ষামূলকভাবে দু’একদিনের ভিতর ঢাকার ওয়ারী ও রাজাবাজার এলাকাকে রেডজোন ধরে লকডাউন করা হবে। তবে, সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী গ্রিন, ইয়োলো ও রেড জোনে ভাগ করা হলেও ঢাকা ও পুরো দেশের জন্য মানদন্ড হবে আলাদা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন, গাজীপুর, নরসিংদী আর নারায়ণগঞ্জে পাইলটিং ভিত্তিতে লকডাউন শুরু করা হবে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পল্টন, কলাবাগান, গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর, গুলশান, রমনা, মতিঝিল, তেজগাঁও, শাহজাহানপুর এবং হাজারীবাগ- এই ১০ এলাকায় লকডাউনের ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রস্তাবনা রয়েছে। ঝুঁকি বিবেচনায় ও কিছু প্যারামিটারের ভিত্তিতে সারাদেশকে রেড, ইয়েলো এবং গ্রিন জোনে ভাগ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, এলাকা ভাগ করার প্রক্রিয়ায় এক লাখ মানুষের মধ্যে ১৪ দিনে সেখানে নমুনা সংগ্রহ, নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে রোগী শনাক্ত এবং এই সময়ের মধ্যে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার হার বিবেচনা করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র জানায়, জোনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে ঠিকই, এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এগুলো প্রযুক্তিভিত্তিক কাজ। শনাক্ত হওয়া রোগীর ভিত্তিতে কিছু প্যারামিটার ঠিক করা হয়েছে। সে হিসেবে এক লাখ মানুষের মধ্যে ১৪ দিনের মধ্যে তিন থেকে ২৯ জন রোগী হলে ইয়েলো জোন, ৩০-এর বেশি হলে রেড জোন এবং তিনজন রোগীর নিচে হলে সেটা গ্রিন জোন—এটা প্রস্তাব করা হয়েছে সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য।
একইসঙ্গে ঢাকার বাইরেও জেলা উপজেলার জন্য এক লাখ মানুষের মধ্যে ১৪ দিনের মধ্যে তিন থেকে নয় ইয়েলো, দশের বেশি হলে রেড এবং তিনজনের নিচে হলে গ্রিন-এটা হচ্ছে জোনাল হিসেবে ভাগ করার একটা প্রাথমিক প্রস্তাবনা। এরসঙ্গে প্রস্তাবনা হিসেবে আরও যোগ হয়েছে ডাবলিং রেট-ডাবলিং টাইম অর্থাৎ ১৪ দিনে কোনও এলাকার রোগী সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে, রোগের গ্রাফিক্যাল ট্রেন্ড, নমুনা কত সংগ্রহ হচ্ছে এবং এসব নমুনার ভেতরে কত শতাংশ পজিটিভ অর্থাৎ সংগ্রহকৃত নমুনার মধ্যে কতজন করোনাতে আক্রান্ত হয়েছেন। এরকম আরও কিছু প্যারামিটার যোগ করে এলাকা ভাগ করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বিশেষভাবে নজর রাখার কথা রয়েছে অধিদফতরের প্রস্তাবনায়।
তবে গণমাধ্যমে লকডাউন বলা হলেও সেখানে কী কী ব্যবস্থাপনা হবে, কোন পদ্ধতিতে কোন বিধি-নিষেধের আওতায় কোন এলাকা আসবে সেটা নির্ধারিত এলাকার জনপ্রতিনিধিরা ঠিক করবেন। কিন্তু বিটুইন দ্য জোন অর্থাৎ রেড জোন থেকে সবুজ বা সবুজ থেকে হলুদ এলাকায় মানুষের যাতায়াত কী হবে সেটা কেন্দ্রীয়ভাবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
সূত্র জানায়, রেড জোন মানেই সম্পূর্ণভাবে এসব এলাকা লকডাউন করে দেওয়া নয়। এসব এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা মেয়র যেভাবে এটা বাস্তবায়ন করলে সর্বোচ্চ সুবিধা পাবেন বলে মনে করবেন সেভাবেই তারা এটি বাস্তবায়ন করবেন। এজন্য সাপোর্টিং ম্যানেজমেন্ট যেমন খাবার, বাজার, ব্যাংকসহ প্রয়োজনীয় বিষয় মাথায় রেখে করতে হবে। কতটুকু ইউনিটে কোন ব্যবস্থা নেবে সেটা স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে করা কমিটি ঠিক করবেন। রেড জোন মানে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, কীভাবে নেওয়া হবে এগুলো ঠিক করার জন্য কমিটি গঠনের প্রস্তাবনাও রাখা হয়েছে।
‘লকডাউনের জোনে ভাগ করা মানেই লকডাউন নয়’ মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, আমরা জোন ঠিক করে দেবো-সেখানে লকডাউন দেওয়া হবে নাকি অন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটা কমিটি ঠিক করবে। তবে এক জোন থেকে আরেক জোনে যাতায়াত কী হবে সে বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। লকডাউনের এলাকা চূড়ান্ত হতে এখনও বাকি আছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান। এ বিষয়ে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।