দেশের আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা নিয়ে সংগঠনটির আমির শাহ আহমদ শফী ও মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর প্রকাশ্য বিরোধ নতুন করে উস্কে দিলেন শফীপুত্র আনাস মাদানীর ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপ।
যেখানে আনাস মাদানী হেফাজত মহাসচিব আল্লামা জোনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনেছেন। এছাড়াও ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে রক্তক্ষয়ী ঘটনার পেছনে বাবুনগরীর জামায়াত সংশ্লিষ্টতাকে দায়ী করেছেন তিনি।
অজ্ঞাত ব্যক্তির সঙ্গে শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীর সেই ফোনালাপ পাঠকের জন্য হুবুহু তুলে ধরা হলো-
অজ্ঞাত ব্যক্তি : আনাস মাদানী সাহেব আমরা তো আপনার ভক্ত। এখন যে আপনার বিরুদ্ধে নানা ধরনের সমালোচনা শুনতেছি, এগুলো একটু এজাহাত (ব্যাখ্যা) করলে ভালো হয়।
আনাস মাদানী : এজাহাত ভাই কয়টা করব? আমার তো আব্বাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়, আব্বা অসুস্থ। সবগুলো যদি এজাহাত করতে যাই, তাহলে তো আমাকে আর কাজ করতে হবে না।
এ সময় ওই ব্যক্তি অনুরোধ করেন, যেন আনাস মাদানী একবার লাইভে এসে সব বিষয় পরিষ্কার করেন।
জবাবে আনাস মাদানী বলেন : ঠিক আছে, আমি একবার আসলাম। এর পরদিন তারা আসবে, আমাকে এর পরদিন আবারও আসতে হবে। এভাবে তো সিলসিলা জারি হয়ে যাবে। জাহেলদের জবাব দেব কী জন্য? আমি আল্লাহর কাছে সোপর্দ করতেছি।
অজ্ঞাত ব্যক্তি : এখন তো পুরো বাংলাদেশ, পুরো কওমি অঙ্গন এ বিষয়গুলো নিয়ে আপনার সমালোচনা করতেছেন। প্লিজ আমরা কাদেরকে এখন আকাবির (পথ প্রদর্শক) বলব? কাদের এখন অনুসরণ করব?
জবাবে আনাস মাদানী বলেন : আপনাদের আকাবির যারা ছিল তারা এখনও বহাল আছে। তাদেরকে মানতে পারবেন, এদের মধ্যে এখনও কোনো ঘাপলা আসে নাই।
অজ্ঞাত ব্যক্তি : মানুষ আমাদেরকে হাসির পাত্র বানাইতেছে, প্লিজ আমাদের রক্ষা করেন।
এ সময় কিছুটা উত্তেজিতভাবে আনাস মাদানী বলেন : এসব আমরা করতেছি না, বাবুনগরী করতেছে। বাবুনগরী জামায়াতের সঙ্গে কাজ করতেছে। ওনার সঙ্গে আপনারা মত বিনিময় করেন।
অজ্ঞাত ব্যক্তি : বাবুনগরী সাহেবকে পুরো বাংলাদেশে আমরা যা দেখলাম, উনিতো সব সময় বাতিলের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
জবাবে আনাস মাদানী বলেন : হ্যাঁ, সব সময় বাতিলের বিরুদ্ধে কথা বলেন। সব সময় জামায়াতের সঙ্গে মিলে কাজ করেন। শাপলা চত্বরে জামায়াতের সঙ্গে মিলে মাইরটা খাওয়াইছে। ডকুমেন্ট আছে তো।
এ সময় অজ্ঞাত ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায় , ডকুমেন্ট থাকলে পেশ করেন, তাহলে আমরা বাবুনগরী বয়কট করব।
জবাবে আনাস মাদানী বলেন : ঠিক আছে, সময় আসলে পেশ করব।
এদিকে এই ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে হেফাজতের নেতাকর্মীদের মধ্যে। এদের কেউ কেউ হেফাজত মহাসচিবকে নিয়ে শফীপুত্রের এমন বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। বাবুনগরীর বিপক্ষেও বলছেন অনেকে।
এদিকে বুধবার (১ জুলাই) বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী তার বিরুদ্ধে আনা জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে আনাস মাদানীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে আল্লামা বাবুনগরী বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। অতীত-বর্তমানে কোনো সময়ই জামায়াতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না; বরং পুরো জীবন আমার লেখালেখিতে ও লাখ লাখ মানুষের বিশাল সমাবেশে বয়ান-বক্তৃতার মধ্যে জামায়াতের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে আমি দেশবাসীকে সচেতন করে আসছি।’
তিনি বলেন, ‘জামায়াত সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আমার সম্পর্কে সে যা বলেছে, সেটা তার পরিকল্পিত মিথ্যাচার। তার এহেন মিথ্যাচার আমাকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রেরই অংশ বলে আমি মনে করি। এগুলো আমার মানহানি করার অপচেষ্টা।’
বাবুনগরী বলেন, ‘কিছুদিন থেকে আমি লক্ষ্য করছি যে, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি মহলের ইন্ধনে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা এবং সাজানো কথা রটিয়ে, উস্কানিমূলকভাবে সরকার এবং প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চক্রান্ত করে যাচ্ছে। এসবের নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর ভাষা আমার নেই।’
তিনি বলেন, ‘মাওলানা আনাস মাদানী ফোনালাপে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের মর্মান্তিক ঘটনার সম্পূর্ণ দায়ভার আমার ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেছেন। সে শাপলা চত্বরের মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে আমাকে জড়িয়ে এমন ডাহা মিথ্যা কথা বলতে পারবে, তা আমি আশা করিনি। অথচ জেলে গেলাম আমি, রক্ত দিলাম আমি। রিমান্ডে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করলাম আমি। সেই রাতে হেফাজতের সমাবেশে কী হয়েছিল তা জাতি জানে, কিন্তু মামলার আসামি হলাম আমি।
প্রসঙ্গত, হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহম্মদ শফীর সঙ্গে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর দ্বন্দ্ব এখন চরমে। এরই জেরে সম্প্রতি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদরাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে সরিয়ে এ পদে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা শেখ আহমদকে। মূলত এর মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে সংগঠনটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এলো হেফাজতের ভাঙনও।