গরীবের ছেলে মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। সামর্থ্যরে অভাবে ছেলের চাহিদা পূরণ করতে পারছিলেন না বাবা, ভাবলেন কি করা যায়? একদিন ছেলেকে নিয়ে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং নবীজীকে অনুরোধ জানালেন ছেলেকে বুঝিয়ে বলতে। নবীজি চিন্তায় পড়ে গেলেন, কারন তিনি নিজেও মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন। তাই সেদিন ছেলেকে কিছু না বলে সাত দিন পর আসতে বললেন। ব্যস, এ কয়দিনে নবীজী নিজের প্রিয় খাবারের অভ্যাসটুকু নিজেও ত্যাগ করলেন।
নবীজীর কথা মত পরামর্শ প্রার্থী বাবা ছেলেকে সাত দিন পর নিয়ে আসলেন, নবীজী বাস্তবতা বুঝিয়ে দিয়ে ছেলেকে মিষ্টি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিলেন। গল্পটি নিশ্চয়ই সবারই কমবেশি জানা। তবুও উল্লেখ করলাম কারণ, অভ্যাস বদলের উপদেশ প্রদানে এর চেয়ে সুন্দর, শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত মনে হয় আর নেই। কাজেই ‘নিজে না বদলালে কিছুই বদলানো যায় না’ কথাটির প্রকৃত অর্থ-‘আগে নিজের মজ্জাগত স্বভাব বা অভ্যাস বদলাও-পরে অন্যকে বদলাতে বলো’।
পৃথিবীতে সবাই শ্রেষ্ঠ হয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু খুব কম মানুষই আছেন যারা শ্রেষ্ঠ কাজটি করতে চান। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাজটি কী? সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণি সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে একটা মাত্র জীব সৃষ্টি করেছেন, যাকে বলা হয় ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব ‘।
কে এই শ্রেষ্ঠ জীব? আমি, আপনি, আমরা যারা মানুষ হয়ে জন্মেছি তারাই পৃথিবীর সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আপনি শুধু এই শ্রেষ্ঠত্বটুকু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরে রাখুন। এটাই হবে একজন মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজ।
লোকে আপনাকে কেন গুরুত্ত্ব দিবে, যদি গুরুত্ত্ব দেয়ার মত কোন কারণ তারা আপনার মাঝে খুঁজে না পায়। আপনি নিজেও তো সবাইকে গুরুত্ত্ব দেন না। যে কারণে আপনি অন্যকে সম্মান করেন, সে কারণগুলো নিজের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করুন; দেখবেন মানুষ আপনাকে ও সম্মান করছে।
মানুষ প্রতিনিয়ত বদলায়, সেটা প্রয়োজনে হোক অথবা অপ্রয়োজনে। প্রকৃতির নিয়মেও বদলায় মানুষ। অবস্থান আর পরিস্থিতির কারণেও বদলায়। তেমনি প্রকৃতিও বদলায় আপন নিয়মে আপন বলয়ে। এখানে বদলে যাবার প্রেরণা সৃষ্টি একটা ইস্যু হতে পারে কিন্তু প্রকৃত বদল বা মজ্জাগত বদল আসতে হবে নিজ থেকে নিজের ভেতরে বাইরে। এরপর মানুষ থেকে মানুষে, সমাজ থেকে সমাজে বদলের স্রোতধারা প্রবাহিত হয়। কিন্তু চলমান সময়ে পরিবর্তন বা বদলে যাওয়া নিয়ে যে ঢাকঢোল পিটানো হয় তাতে এর প্রকৃত উদ্দেশ্যই যেন বিলীন হয়। কেন বদলে যেতে বলছি, কাদের বদলে যেতে বলছি, নিজেরা কতোটা বদলাতে পেরেছি? কীভাবে বদলাতে হবে? এসব প্রশ্ন এ ধরণের উদ্যোগকে বিদ্ধ করে। তবুও বাস্তবতা হলো আমাদের বদলাতে হবে। কেননা, নিজে না বদলালে কিছুই বদলানো যায় না।
আমি বিশ্বাস করি, অস্তমিত সূর্যকে কেউ প্রণাম করে না। নষ্ট সিন্দুকে কেউ স্বর্ণ রাখেনা। নিঃশ্বাসের আড়ালে বেঁচে থাকার নাম যদি জীবন হয়, তবে দীর্ঘায়ু অভিশাপ। জীবনটা চ্যালেঞ্জের। এখানে নিজেকে সেরা প্রমাণ করেই বেঁচে থাকতে হয়। নয়তো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আপনি শুধুই বেঁচে থাকবেন নিঃশ্বাস নিয়ে, কিন্তু টিকে থাকতে পারবেন না।
জীবিত অবস্থায় এমন কোনো কাজ করবেন না, যেন সৃষ্টিকর্তা আপনাকে “সৃষ্টির সেরা জীব ” বলে যে গর্ব করতো, সেটা নষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীর সকল এওয়ার্ড বা সকল পদবী পাওয়া যায় সফলতার পর বা বড় কোনো অর্জন এর পর। অথচ আপনি সেরা কিছু করার আগেই সৃষ্টিকর্তা আপনাকে “সৃষ্টির সেরা জীব”এর উপাধি দিয়ে দিল।
একবার ভেবে দেখুন, কত বড় বিশ্বাস নিয়ে তিনি আপনাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এবার জন্মের পর আপনি শুধু সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এই উপাধীটির যোগ্য হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করুন। এটাই আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ।
নিয়ম মানার মানসিকা তৈরি করতে হবে। প্রত্যেকের উচিত স্বাভাবিক নিয়মানুবর্তিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সচেতন থাকা, নিজে নিয়ম মেনে চলা এবং অন্যকে মানতে উৎসাহিত করা। প্রত্যেক পেশাজীবি যে যার অবস্থান থেকে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করা এবং পেশাগত সততার প্রমাণ দেখানো; দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা। সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা। অন্যের দোষারোপ করার আগে আত্মসমালোচনা করা। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।
মানুষ কখন মানুষকে মানুষকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে? যখন ঐ মানুষটির মাঝে এমন কিছু থাকে যা ভালো লাগার মত। কিছু শপথ নিন নিজের জীবনকে পাল্টে দিতে। কিছু চ্যালেঞ্জ নিন নিজেকে বদলে দিতে।
নিজেকে অন্যের আস্থাভাজন করে তুলতে কিংবা অন্যের ভালোবাসার মানুষ হিসেবে যোগ্য করে তুলতে আপনাকে পাহাড় কাটতে হবে না, হিমালয়ের চূড়ায় ও উঠতে হবে না, এমনকি আটলান্টিক মহাসাগর ও পাড়ি দিতে হবে না। শুধু নিজেকে বদলানোর একটা শপথ নিন। চলুন ৪ টি প্রতিজ্ঞা করি-
১.যে কাজ আপনি প্রকাশ্যে করতে পারবেন না, আজ থেকে তা গোপনেও করবেন না। ( এই শপথ করতে পারলে একজন মানুষ নিঃসন্দেহে সকল পাপকাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে )
২. যে কথা সবার সামনে বলা যায় না, সে কথা আড়ালেও বলবেন না। ( এই শপথ যে কাউকে অশ্লীল শব্দ চয়ন, অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করে কারো সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেয়া থেকে নিয়মিত বিরত রাখবে)
৩. যে সব জিনিস লুকিয়ে খেতে হয়, সেসব জিনিস ছুঁয়েও দেখবেন না। ( এই শপথটি যে কাউকে মদ, ইয়াবাসহ সকল নেশা থেকে মুক্ত রাখবে)
৪. যে সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে বলা যায় না, সে সম্পর্ক গোপনেও রাখবেন না। ( বর্তমানে এই শপথটি অত্যন্ত প্রয়োজন)
কিন্তু আমাদের সমাজে লক্ষণীয়, একজন সেবক ডাক্তার কি তাঁর পেশায় ঠিক আছেন? তিনি কি রোগীকে সর্বোচ্চ সেবাটি দিচ্ছেন? তিনি কি সপ্তাহে বা মাসে একবার নিজ এলাকায় গরীব রোগীদের বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছেন? আমরা দেখছি তাঁর উল্টো চেহারা। ডাক্তারের কাছে রোগী আসা মানে আর্থিকভাবে তাঁকে অর্ধেক মেরে ফেলা। রোগীর হিস্ট্রি না জেনে টেস্ট নির্ভর কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন একজন মহৎ পেশার মানুষ! কত টাকা হলে তাঁর বিলাসিতার সাধ মিটবে তা তিনি নিজেও বোধহয় জানে না।
একজন শিক্ষক, যিনি মানুষ গড়ার কারিকর, কত টাকা চাই তাঁর? টাকার কাছে বিবেককে বিক্রি করে কেমন মানুষ গড়বেন? একজন ব্যবসায়ীর কত টাকা দরকার ? দেশের মানুষকে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামে ফেলে দিয়ে ইচ্ছে মতো দাম বাড়াবেন, কমাবেন; ভেজাল মিশিয়ে উচ্চলাভের নেশায় মত্ত হয়ে যে শিশুর অনাগত ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত ও হুমকির মুখে ঠেলে দিলেন, আপনার শিশুটি কি এর বাইরে? কেন আমরা এসব করছি? তাই আগে নিজেকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
মনে রাখবেন – যেখানে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, সব লজিক ফেইল করে ; যেখানে কোনো স্ট্র্যাটেজি কাজ করে না, সেখানে শুধু একজনই সব কিছুর সমাধান করে দিতে পারে- তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা। বিপদে ধৈর্য হারা না হয়ে বা সুযোগের জন্য কারো পা ধরে বসে না থেকে, শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছেই প্রার্থনা করুন। তিনি আপনাকে বিপদে ফেলার জন্য সৃষ্টি করেনি, তিনি আপনাকে অসুখে রাখতেও সৃষ্টি করেনি। সৃষ্টির শুরুতেই তিনি আপনাকে শ্রেষ্ঠ জীবের মর্যাদা দিয়েছেন।
তিনি নিশ্চয় চান না, তার সৃষ্টি করা শ্রেষ্ঠ জীবটি দুঃখে থাকুক। চলুন, প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, অপরাধ মুক্ত থাকতে সাহায্য চাই, তাঁর দেওয়া বিধি বিধান মেনে চলি। প্রার্থনাই হলো জীবন পরিবর্তনের শ্রেষ্ঠ ম্যাজিক। নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার নাম জীবন নয়, জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে আত্মবিশ্বাস নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের নামই জীবন, মানবজীবন।