ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি আলোচনায় আসার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন দাবি করেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রক্তের সম্পর্ক। চীনের সঙ্গে শুধুই অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
কিন্তু রক্তের সম্পর্কের সেই দেশ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ‘সম্পর্কের ফাঁকফোকর মেরামত’করতে দুদিন ধরে ঢাকায় অবস্থান করলেও দেখা মেলেনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের। হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা দু’দিন ধরে ঢাকায় এলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবস্থান করছেন সিলেটে। সেখানে বসেই ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরকে ‘খুবই খুশির খবর’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি। বুধবার সকালে সিলেটে বসেই তিনি বলেছেন, ‘খুবই খুশির খবর যে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব আমাদের দেশে সফরে এসেছেন। তার সাথে অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সফরকে সিলেটে বসে খুশির খবর বললেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ দূতকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউ যাননি। ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাশ তাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার আচমকা ঢাকা সফর নিয়ে কৌতূহল যেমন ছিল তেমনই ছিল উত্তাপও। সফরের শেষ পর্যায়ে কৌতূহল আর উত্তাপ আরও বেড়েছে। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও কিছুটা হতবাক হয়েছেন। অনেকেই অংক মেলাতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু সফরটি ভারতের আগ্রহে সেজন্য হয়তোবা ঢাকা নতুন কোনো কৌশল নিয়েছে। অত্যন্ত গোপনীয়তায় ভরা এই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অজানা। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে সাক্ষাৎ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। এমনকি কোন ফটোগ্রাফও রিলিজ হয়নি। যে ছবি সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে তা গত মার্চ মাসে শ্রিংলা যখন ঢাকা এসেছিলেন তখনকার। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সময়ও বারবার বদল হয়েছে। শুরুতে বেলা তিনটার সময় নির্ধারিত ছিল। দু’দফা পরিবর্তনের পরে রাতে বৈঠকটি হয়েছে। তখন শ্রিংলাকে হোটেলেই বসে থাকতে হয়েছে। বিমানবন্দরেও কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। অভ্যর্থনা জানাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়েরও কেউ যাননি সেখানে। এই সফর নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায়ও তেমন কোন উচ্ছ্বাস নেই। তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো লিখেছে, বাংলাদেশে বিমান বন্দর তৈরিতে সহযোগিতার কথা আগেই ঘোষিত হয়েছিল। এবার তিস্তার ওপর সেচ প্রকল্পেও ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সাহায্য করছে চীন। এরপর আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনি দিল্লি। এর প্রভাবেই বিদেশ সচিবকে আকস্মিক ঢাকায় পাঠিয়েছে মোদি প্রশাসন।
তবে ভারত যতই তৎপর হোক না কেন তিস্তায় সেচ প্রকল্পে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা নিতে যাচ্ছে- সেখান থেকে সরকার পিছিয়ে আসতে পারছে না।
আনন্দবাজার পত্রিকা ‘হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বিদেশ সচিব’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে নরেন্দ্র মোদির জমানায় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। দ্য হিন্দু এক রিপোর্টে বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় দু’ দেশের সম্পর্কের একটি রোডম্যাপ নিয়ে কথা হয়েছে। ঢাকার বিদেশ মন্ত্রণালয় থেকেও কিছু বলা হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের সঙ্গেও ভারতের বিদেশ সচিবের মোলাকাত হয়নি। ড. মোমেন মঙ্গলবার বিকেলেই তিনদিনের এক সফরে সিলেট চলে গেছেন। আসলে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এসেছিলেন তা হয়তো এখনই জানা যাবে না।তবে মিডিয়া রিপোর্ট এবং ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, ঢাকায় চীনের উপস্থিতি নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন ভারত। বিশেষ করে তিস্তা প্রকল্পে চীনের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার খবর দিল্লিকে বিচলিত করেছে। চীনা ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা বাংলাদেশে চালানোর ছাড়পত্র দেয়ায় উদ্বেগের মাত্রা আরও বেড়েছে। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর প্রকল্পে চীনা অর্থায়নকেও ভারত সন্দেহের চোখে দেখছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে চীনের ভূমিকা নিয়েও দিল্লি নানাভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ঢাকার একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলছিলেন, ভারত-চীন যুদ্ধ হলে ঢাকার ভূমিকা কী হবে এটাও তারা জানতে চাচ্ছে। কারণ, লাদাখে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য মারা যাবার পর ঢাকার তরফে নিন্দাসূচক কোন বক্তব্য দেয়া হয়নি। ছিল শান্তির পক্ষে আওয়াজ।
আনন্দবাজার এই সফরকে আনঅফিশিয়াল বলে উল্লেখ করেছে। রিপোর্টে বিশেষজ্ঞদের বরাতে পত্রিকাটি জানায়, মোদির জমানায় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে ভারতের। গত বছর নাগরিকত্ব আইন বা জাতীয় নাগরিকপুঞ্জিকে কেন্দ্র করে বিজেপি নেতাদের মন্তব্য ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছিল। এখন লাদাখে চীন-ভারত স্নায়ু যুদ্ধ চলছে। আর পুরনো সুসম্পর্কের জেরে বাংলাদেশের উপর ক্রমাগত প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে চীন। ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি আটকে আছে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার জলস্তর ধরে রাখার প্রকল্পে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চীন। করোনার সম্ভাব্য টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা বাংলাদেশে চালানোর ছাড়পত্র পেয়েছে চীন।
ওদিকে ইমরান খান সম্প্রতি হাসিনাকে ফোন করে ঢাকার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর ঘিরেও ঘরোয়াভাবে কট্টরপন্থিদের সামনে হাসিনা সরকার অস্বস্তিতে পড়ছে বলে অনেকের মত। যদিও বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক তা ঐতিহাসিক। সম্প্রতি বাংলাদেশকে ১০ টি রেল ইঞ্জিন দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের দাবি, ইঞ্জিনগুলো পুরনো। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেছেন, এমন ক্ষতিকর কাহিনীগুলো একই জায়গা থেকে উঠে আসছে।
দ্য হিন্দু লিখেছে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার এই সফরকে বিশেষ সাধুবাদ জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি করোনা ভাইরাসের কারণে গত চার মাসের মধ্যে প্রথম কোনো বিদেশি অতিথি হিসেবে শ্রিংলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। বৈঠক সম্পর্কে অবহিত এমন একাধিক সূত্র বলেছেন, এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দুই বছর মেয়াদী একটি রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা করেছেন তারা। আলোচনায় উভয়পক্ষ তুলে ধরেছেন তাদের মধ্যে সম্প্রতি ভ্যন্তরীণ জলপথ বিষয় প্রোটোকল, ত্রিপুরা ইস্যু, মালবাহী ফেরি চলাচল এবং বাংলাদেশকে ভারতের সম্প্রতি দেয়া লোকোমোটিভের বিষয়। উপরন্তু উভয়পক্ষ আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ সম্পন্ন করার আশা প্রকাশ করেছেন। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী বা সুবর্ণজয়ন্তীতে আগামী বছর উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে বেশ কিছু প্রকল্প। এর মধ্যে রয়েছে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন খুলনা তাপবিদ্যুত কেন্দ্র।
এক প্রশ্নের জবাবে বৈঠক সম্পর্কে জানেন এমন সূত্র দ্য হিন্দুকে বলেছেন, ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) অথবা বাংলাদেশে চীনের সাম্প্রতিক তৎপরতার মতো জটিল ইস্যুগুলো বৈঠকে আলোচিত হয় নি। ওই সূত্র আরো বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তি এতটাই মজবুত যে, সেখানে অন্যদের নিয়ে এখন আলোচনার কোনো মেরিট নেই।
ওদিকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও হর্ষবর্ধন শ্রিংলার মধ্যকার বৈঠককে ‘চমৎকার’ বা এক্সিলেন্ট বলে অভিহিত করেছেন সূত্রগুলো। করোনা ভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর প্রথম কোনো বিদেশী অতিথি হিসেবে শ্রিংলাকে স্বাগত জানিয়ে শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
দু’পক্ষ কিভাবে তাদের সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে পারে সে জন্য দূত পাঠানোর জন্য তিনি মোদির প্রশংসা করেন। সূত্র আরো বলেছেন, উভয় পক্ষ ব্যবসায়িক, সরকারি ও মেডিকেল বিষয়ক সফরকে অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। একটি জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন শিগগিরই বিভিন্ন প্রকল্প ইস্যুতে সম্পর্কের বিষয়ে বৈঠকে বসবে। উভয় পক্ষ কানেক্টিভিটি বা সংযুক্তিকে উন্নত করার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। একই সঙ্গে কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, বিশেষ করে টিকা ও ওষুধের বিষয়ে। একই সঙ্গে আলোচনা করেছেন যৌথভাবে মুজিববর্ষ পালনের বিষয়েও।
সূত্র আরো বলেছেন, আলোচনায় শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরেছেন এবং মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবতর্নের বিষয়ে কথা বলেছেন।