বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের একজন প্রকৃত বন্ধু। ক্ষমতায় আসা থেকেই নয়াদিল্লির নিরাপত্তা এবং স্ট্র্যাটেজিক উদ্বেগের বিষয়ে তিনি সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। কিন্তু ভারতের হয়তো এমন একটি উত্তম প্রতিবেশী লাভের আশা করার কথা ছিল না।
আসামে সহিংসতা এবং সন্ত্রাসবাদ কমে এসেছে । আর তার জন্য শেখ হাসিনার উদারনৈতিকতাকে প্রধানত ধন্যবাদ জানাতে হয়। ২০০৯ সালে তিনি যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন তার সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সক্রিয় থাকা ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম উলফার নেতৃবৃন্দকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া ।
উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে ফাঁকি দিয়ে সহজেই সীমান্ত অতিক্রম করে যেত বাংলাদেশে। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে সকল প্রকার ভারতীয় বিদ্রোহী ঘাঁটিগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
তিনি এটা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে, ভারতবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ঠাঁই বাংলাদেশে হবে না। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স ( আইএসআই) কেও বাংলাদেশ থেকে পাততাড়ি গুটাতে হয়েছিল।
কিন্তু আজ চীন বাংলাদেশে তার ডানা মেলেছে। সেটা আক্ষরিক অর্থেই ভারতের ঘাড়ের উপরে ।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছেন । ইমরানের এই ফোনকল প্রকারন্তরে শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের একটা চেষ্টা।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের আভ্যন্তরীণ এজেন্ডা যা নেয়া হয়েছে, তাতেই চীন এবং পাকিস্তানকে একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান চীনা স্বার্থের পটভূমিতে শঙ্কিত হয়ে ঢাকায় ছুটে গেছেন । এর আগে বেইজিং বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্ক রেয়াত ঘোষণা করেছিল। বাংলাদেশ থেকে চীনে পণ্য পাঠাতে শুল্ক রেয়াত দেয়া হয়েছে শতকরা ৯৭ শতাংশ । মহামারিতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার জন্য পাঠিয়েছে একটি মেডিকেল টিম । এমনকি বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন পরীক্ষার জন্য একটি চীনা কোম্পানিকে অনুমতি দিয়েছে। আর এইসব অগ্রগতিগুলো নয়াদিল্লি উৎসাহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে চলছে। কিন্তু যখন তিস্তা নদী ভিত্তিক একটি প্রকল্পে চীন একশ কোটি মার্কিন ডলারের ঘোষণা দিয়েছে, এরপরই ভারত বিপদ ঘণ্টা শুনতে পেয়েছে। পরিহাসের বিষয় হলো, তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যা রয়েছে।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ঢাকা সফরে গিয়েছিলেন। আর তখনই তিস্তাচুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ওই চুক্তি সম্পাদনে বেঁকে বসেন । এবং সেই থেকে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা নদী নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব মঙ্গলবার ঢাকায় উড়ে গেছেন এবং বুধবার অপরাহ্ণে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে একটি বার্তা বয়ে নিয়ে গেছেন। মি. শ্রিংলা ওয়াশিংটনে ভারতের দূতাবাসে একটি সংক্ষিপ্ত মেয়াদে দায়িত্ব পালনের আগে বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন । ওয়াশিংটন থেকে ফিরেই তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পান । তিনি বাংলাদেশকে ভালোই জানেন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে তার রয়েছে একটি উত্তম সমীকরণ।
তিনি কিছুদিন আগেই অভিযোগ করেছেন যে, ভারতীয় গণমাধ্যমের একাংশ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ককে ভুলভাবে চিত্রিত করছে।
ভুল যখন ভারতের
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ত্রুটি-বিচ্যুতির দিক থেকে বেশিরভাগেরই দায় ভারতের । বাংলাদেশি অভিবাসীদের অবৈধ অভিবাসনকে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত করার কারণে একটি বন্ধুপ্রতিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ।
অথচ এই বিষয়টি ভারতের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থের দিক থেকে এর উদ্বেগ সামান্য । কিন্তু ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং তার ক্ষমতাশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই বিষয়টিকে একটা উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত করেছিল। এমন কি মি. শাহ এর আগে বাংলাদেশি অভিবাসীদেরকে ‘পতঙ্গের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ঢাকা তখন এই বিষয়ে কোন কথাই উচ্চারণ করেনি । শেখ হাসিনা সরকার ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদের অপসারণ এবং কাশ্মীরে ক্র্যাকডাউন চালানোর বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি । কিন্তু আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস এবং সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ হয়ে আছে।
প্রথমেই বলতে হবে সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের কথা। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পাকিস্তান আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, যারা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার, তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ হলেই ভারতে আশ্রয় লাভ করতে পারে । এবং ওই তিন দেশের কেবল মুসলমান ছাড়া অন্য সবাই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারে। লোকসভায় এই বিষয়ে বিল উপস্থাপন করে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই তিন দেশের ধর্মীয় নির্যাতনের বিষয়ে কথা বলেন। তবে শেখ হাসিনার সরকার আহত বোধ করতে পারে, এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী । সে কারণেই তিনি সংসদে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করছেন না । বরং দেশটির পূর্ববর্তী সামরিক শাসক আমলের ঘটনার বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদেরকে গর্বিত মনে করে যে, তারা একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র, যার পরিচয় ধর্ম দ্বারা সংজ্ঞায়িত নয়। বাংলাদেশের হিন্দুরা ধর্মীয় নিপীড়নের ভয়ে ভীত নন। তাই পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে তুলনা করাটা বাংলাদেশের ভালো ঠেকেনি । কিন্তু তারপরেও ঢাকা এই বিষয়ে মন্তব্য না করে বরং সংযত থেকেছে । প্রকাশ্যে এই বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্যই করেনি।
আসামে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু সংকট অতি পুরাতন। আশির দশকের গোড়ায় এই বিষয়ে আসামে বড় আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই কারণে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের কোনো হানি ঘটেনি । কিন্তু চলতি সময়ে এনআরসি এবং বিদেশি বিতাড়ন বিষয়ে ঢিলেঢালা মন্তব্য করা বাংলাদেশের জন্য স্বাভাবিক উদ্বেগের কারণ তৈরি করেছে । যদিও ভারত ঢাকাকে এই মর্মে নিশ্চিত করেছে যে এনআরসি ভারতের একটি আভ্যন্তরীণ বিষয় । কিন্তু অনেক বাংলাভাষী মুসলিম, যাদেরকে ক্যাম্পে রেখে দেয়া হয়েছে, তারা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পারে, এটাই বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ। নয়া দিল্লির দাঙ্গা এবং ভারতে সাধারণভাবে মুসলিমবিরোধী প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের অনেক নাগরিককে বিরক্ত করেছে।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে যেতে চাইলে ছাত্ররা ব্যাপকভিত্তিক প্রতিবাদের হুমকি দিয়েছিল । যদিও মহামারির কারণে ওই সফর বাতিল করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন বিষয়ে ভারতের অব্যাহতভাবে জিগির তোলায় স্বাভাবিকভাবে ভারতের প্রতি বন্ধু পরায়ণ নাগরিকদের রুষ্ট করেছে। এটা বাংলাদেশে এখন আর বিরোধীদলীয় কোনো বিষয় নয়, যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক, তারাও ভারতের প্রতি নাখোশ হয়েছে ।
শ্রিংলা তার পক্ষে যতটা সম্ভব এটা সারিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করবেন । তিনি হয়তো বাংলাদেশের ঝুঁকে পড়া (চীনের দিকে) নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবেন । কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন আসন্ন। সেটা হবে আগামী বছরের গোড়ায়। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বাংলাভাষী মুসলিম এবং অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি বড় আকারে আসবে।