ভারতীয় গণমাধ্যম যখনই বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়নের বিস্ময় নিয়ে রিপোর্ট লিখে, তখন আমার প্রথমেই খটকা লাগে। সন্দেহ জাগে। তাই আমি ফিনানশিয়াল পত্র-পত্রিকাগুলোর দিকে নজর রাখি। বুঝতে চেষ্টা করি, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন কোনো সমঝোতা চুক্তিতে যাচ্ছে কিনা । এবং সত্যি বলতে কি, আমি কখনো প্রকৃত ঘটনা বুঝতে ব্যর্থ হইনি । এধরনের রমরমা খবর তৈরির পেছনের প্রকৃত ঘটনা হলো নতুন চুক্তি করা।
সত্যিকার কিছু খবর তৈরির ঘটনা বেশ বিরল। উদাহরণ হিসেবে কয়েক মাস আগের কথা বলা যায় । ভারতীয় সংবাদপত্র হঠাৎ বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে শুরু করলো ।
তারা বলতে শুরু করল যে, একটি ফরাসি ফার্ম বাংলাদেশে একটা নতুন রিফাইনারি করা নিয়ে খুব মেতে আছে। আর এর সহযোগিতায় আছে একটি ভারতীয় ফার্ম। কিন্তু এরপর জুলাই মাসের শেষে যখন ভারতীয় গণমাধ্যম ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক ধ্বসে যাওয়ার খবর দেয়া শুরু করলো, আমি তো আগে থেকেই সন্দিহান ছিলাম যে এমন কি ঘটলো, এখন সেটা চায়ের কাপে ঝড় উঠল! এরপরে বোঝা গেল যে, সিলেট বিমানবন্দরের রেনোভেশনের কাজটি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিল ভারতীয় নির্মাণ পতিষ্ঠান লারসেন এবং টারবো। কিন্তু তারা দরপত্রে হেরে যায় । এটি পেয়ে যায় বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ।
এখন আপনাকে অনেক নিরাপত্তা পরামর্শক বলে দিবে, বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রতি খুবই রেগে আছে। কিন্তু কেন এত রাগারাগি? তার কারণ হলো, বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপে অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরি হচ্ছে । কিংবা আপনাকে বলে দিবে ভারতীয় ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসির জন্য খুবই রেগে আছে বাংলাদেশ। আসলে এর কোনোটাই সত্য নয়। সত্যটা হলো শেখ হাসিনার সরকারের অভ্যন্তরে এসব বিষয়ে সরাসরি কোনো উদ্বেগ নেই। তার প্রাথমিক লক্ষ্য হল, গভীরভাবে অজনপ্রিয় হয়ে পড়া দলটি (আওয়ামী লীগ) যাতে ক্ষমতায় টিকে থাকে,সেজন্য প্রয়োজনীয় ভারতীয় সমর্থন জোগাড় করা।
গল্পের পেছনে গল্প
ভারতীয় সংবাদপত্র দাবি করলো যে, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখা করতে চাননি এবং সেটা চার মাস হয়ে গেছে । যদিও পৌনঃপুনিকভাবে রিভার সাক্ষাৎকারের জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
কৌতূহল উদ্দীপক বিষয় হলো, ভারতীয় সংবাদপত্রগুলো এই খবর এমনভাবে প্রকাশ করছে যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে এবং সেটাও কিনা বাংলাদেশি এক সরকারপন্থী সংবাদপত্রের সম্পাদক শ্যামল দত্তের উদ্ধৃতি দিয়ে । অথচ ওই পত্রিকাটি যে এই খবরটি দিল, সে কিন্তু নিজেও খবরটি প্রকাশ করেনি । বরং একটি ভারতীয় পত্রিকার বরাত দিয়েই খবরটি দত্ত প্রকাশ করেছিলেন।
মাইক্রোসফট এক্সেল জারগণ অনুযায়ী, এই বিষয়টিকে বলা হয় সার্কুলার রেফারেন্স । একটি ভারতীয় সংবাদপত্র একজন বাংলাদেশি সম্পাদকের বরাতে খবর দিল, হাসিনা ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে চার মাস ধরে দেখা করছেন না। অথচ ওই বাংলাদেশি সম্পাদক প্রকৃতপক্ষে এই খবরের সূত্র হিসেবে একটি ভারতীয় সংবাদপত্রের বরাত দিয়েছিল। মাইক্রোসফট এক্সেল এধরনের পুনরাবৃত্তিকরণ ঘটালে একটি ‘এরর মেসেজ’দেখায়। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতীয় বিশ্লেষকগণ, যারা নিজেদের খুব প্রাসঙ্গিক দেখতে চান, তারা ওইধরনের একটি সার্কুলার রেফারেন্সকেই ভিত্তি ধরেই হৈচৈ ফেলে দিলেন।
বলছিলাম সার্কুলার রেফারেন্সের কথা । এই খবর সকল পক্ষের জাতীয়তাবাদী ও ফ্যানাটিকদের ব্যাপকভিত্তিক মিডিয়া ‘হাইপ’ তৈরি করতে উৎসাহিত করেছিল। এরমধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে শেখ হাসিনার একটি টেলিফোন আলোচনা হয়। কিন্তু এটা কোন কাজই দেয়নি । পরে বলা হয়েছে যে, কোভিড–১৯ এর কারণে গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো বিদেশীকেই সাক্ষাৎ দেননি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত এবং বাংলাদেশের নতুন সম্পর্ক সত্যিই কি হিমশীতল হয়েছে ? আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর। উভয়পক্ষের সম্মতি ছাড়া এই সম্পর্ক বাঁচতে পারে না । আর সমস্যা হলো, প্রত্যাশা পূরণের ব্যবস্থাপনাগত। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে ভারত সফর করেছিলেন শেখ হাসিনা। তখন তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, সারা জীবনভর সেটা তারা মনে রাখবে।’
সমস্যাটা হলো, ভারতীয় কূটনীতিকরা একইভাবে বিষয়টিকে ভেবে দেখতে পারেন না। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একতরফা চুক্তিগুলো এটাই দেখাচ্ছে যে, ভারতীয়রা বিশ্বাস করে যে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে । এর বিনিময় হিসেবে তারা আশা করে যে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সবসময় ভারতের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবেন। কিন্তু তার বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে কিছু দেবে না । কিন্তু শেখ হাসিনা যতদিন ক্ষমতায় রয়েছেন, তিনি অবশ্যই সর্বদা ভারতকে দেয়া আনুকূল্যের বিনিময় ফিরতি সুবিধা আশা করবেন।
বাংলাদেশ সরকারের দরকার মেগা প্রকল্প
শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত তাদের ইচ্ছা পূরণ করে এসেছেন। এখন বাংলাদেশ আর্থিক সংকটে । তার যা রাজস্ব আয়, তার থেকে তাকে প্রায় দ্বিগুণ খরচ করতে হবে । ২০১৯–২০২০ সালে তারা ব্যাংকিং খাত থেকে এতটাই বেশি ঋণ করেছে, যা গত ৪৯ বছরের মোট ঋণের সমান।
বাংলাদেশের নেতৃত্ব এখন সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং আমলাতন্ত্রকে তোয়াজ করছে । গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা তিনশো ভাগ। যদিও তাদের সেবার মান উল্লেখযোগ্যহারে নিচের দিকে নেমে গেছে। ২০১৯ সালের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সূচক অনুযায়ী, যুদ্ধবিধ্বস্ত দামেস্ক এবং নাইজেরিয়ার লাগোসের থেকে ঢাকাই হল সবথেক বেশি বসবাসের অযোগ্য নগরী। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ভালো । তারা এটা বাগিয়ে নিতে পেরেছে, কারণ তারা সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে পেরেছে । তারা একটি প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনে যথেষ্ট স্বচ্ছতার সঙ্গে কারচুপি করে সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছে।
যদিও সরকার পৌনঃপুনিকভাবে জনগণের উপর পরোক্ষ করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে চলছে । কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা রাজস্ব বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর এখন কোভিড–১৯ মহামারির পরিস্থিতিতে সরকারের রাজস্ব আদায় ক্রমাগতভাবে কমছে।
সরকারের দরকার প্রচুর টাকা । এবং এই টাকার একটা বড় উৎস হলো ভ্যাট ও ট্যাক্স । এবং বড় প্রকল্পের জন্য আমদানি করা যন্ত্রপাতির উপর শুল্ক। অন্য অনেক শিল্প, যার মধ্যে ব্যাংক,বীমা, কোম্পানি, জ্বালানি, শক্তি, সিমেন্ট, স্টিল রয়েছে, সেখানে সরকারের জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাজস্ব আহরণের সুযোগ রয়েছে। এর ফল হিসেবে সরকার ভেবেছে যে, যত বেশি নতুন প্রকল্প নেয়া যায়, তাহলে ঘাটতি কমবে ও আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক শিল্প পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হবে।
একটি কল্পিত চীনা ঋণের ফাঁদ ?
যখন অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক আপনাকে বিশ্বাস করিয়ে দেবে যে, বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ প্রকল্প ব্যাপকভিত্তিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে । আর এ কারণে ঢাকা চীনা ঋণের ফাঁদে পড়তে পারে, তখন আসলে প্রকৃত সত্যটা বিপরীত।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় সাতাশটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। তার টাকার পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । আন্তর্জাতিক প্রকাশনাগুলোর দাবি অনুযায়ী, চীন বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে। কারণ তারা তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ প্রকল্পকে সফল করতে চায় । আর সেখানে এই প্রকল্পে ভারতীয় প্রভাবকে প্রতিহত করা তাদের লক্ষ্য । ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে কেবলমাত্র ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাতটি প্রকল্প সই হয়েছে। এবং চার বছরে কেবলমাত্র ১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাস্তবে বন্টন হয়েছে। এই পরিসংখ্যান মনে রেখে আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে যে, বাংলাদেশ সরকার এক বছরে তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।
যদিও ভারতীয় মিডিয়া দাবি করেছে যে, তাদের উন্নয়ন বাজেটের শতকরা ২৮ শতাংশ অর্থাৎ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশে যাচ্ছে । কিন্তু বাস্তবতা হলো শেখ হাসিনার সরকার গত এক দশকে নয়াদিল্লির সঙ্গে তিনটি বাণিজ্যিক চুক্তি সই করেছে । এর মধ্যে রয়েছে ৮৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রথম লাইন অফ ক্রেডিট থেকে ৬০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তাদের দ্বিতীয় ক্রেডিট লাইনের পরিমাণ হলো ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি থেকে এপর্যন্ত মাত্র ৮ দশমিক ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি সই করেছে । আর ভারতের তৃতীয় ক্রেডিট লাইনের পরিমাণ হচ্ছে সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার । কিন্তু তাদের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের তৃতীয় ক্রেডিট লাইন থেকে বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত কোনো চুক্তি সই করেনি । ভারত বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ ক্রেডিটলাইন ঘোষণা করেছে। সেটা প্রতিরক্ষা খাতে । আর তার পরিমাণ হচ্ছে ০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । কিন্তু এ থেকে কি খরচ করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ভারত এবং চীন উভয় দিক থেকেই যে তহবিল আসছে তার ধারাটা ক্ষীণ। এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে ঘাটতি এবং নিম্নমুখী রাজস্ব আয় তাকে চেপে ধরছে । সেকারণে বাংলাদেশ সরকারের সামনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বড় প্রকল্প গ্রহণ করে বাজেটকে ভারসাম্যমূলক রাখার চেষ্টা করাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্রের বন্ড রেটে পতন ঘটে এবং বৈশ্বিক পুঁজি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রবেশ করে । আর তার ফল হিসেবে বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বৃহৎ অংকের পুঁজি লাভ করেছে । এর বাইরে গত তিন দশকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিরাট ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশে বিনিয়োগে । আর সেকারণে এইসবের সম্মিলিত ফল হিসেবে বাংলাদেশের বহিঃস্থ ঋণের পরিমাণ ন্যূনতম রাখা সম্ভব হয়েছে । সে কারণেই বাংলাদেশ অন্যান্য বহু উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তাকে একটা ভালো অবস্থানে রেখে দিয়েছে।
কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক পুঁজি এখন পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘সেফ হেভেন’ খুঁজছে । এবং সকলে সচেতন রয়েছে যে, বাংলাদেশের সরকারি আর্থিক ডাটা ব্যাপকভাবে শঠতাপূর্ণ এবং অবিশ্বস্ত । তবে মন্দের ভালো এই যে, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই এখন একটি অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
বিশ্বে এখন পর্যন্ত একটি দেশই আছে, যে কিনা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ নিয়ে বসে আছে । এবং তারাই বৃহৎ প্রকল্পে বড় ধরনের তহবিলের যোগান দিতে পারে। সুতরাং এতে কোনো বিস্ময় নেই যে, লকডাউনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার একটি পত্র পাঠিয়েছে চীনের কাছেই । এবং তাদের কাছে ২৬ টি প্রকল্পে ১৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চেয়েছে। এই ২৬টি প্রকল্পের মধ্যে নয়টিই নতুন।
তীব্র প্রতিক্রিয়া
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা বিরাট অঙ্কের অর্থ। বাংলাদেশের মতো কোন একটি দেশে বিশ্বের আর কোন দেশ ১৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে না । অবশ্য যদি স্ট্র্যাটেজিক কারণ থাকে তবে আলাদা কথা। সুতরাং এটা বোধগম্য যে, বাংলাদেশ সরকার হয়তো চীনকে এমন সংকেত দিয়ে থাকতে পারে যে, তারা চীনা সংগীতের সুরে নৃত্য করতে প্রস্তুত রয়েছে।
এটা কৌতূহলউদ্দীপক বিষয় যে , বাংলাদেশ চীনের কাছে তার যে অভিপ্রায়ের তালিকা পাঠিয়েছে তার মধ্যে তিস্তা নদীর প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্বাসনের জন্য ৮৫৩ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আশা করেছে । তবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে , এই প্রকল্পে বিনিয়োগ আশা করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সম্ভবত ভারতীয় নিরাপত্তা বলয়ের আস্থায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থাকতে পারেন। অবশ্য এই প্রকল্পটি নতুন নয়। তিস্তা নদীর উপর একটি কারিগরি সমীক্ষা চালানোর জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছিল । এই সেচ প্রকল্পটি অবশ্য ভারতের উপর কোন নিরাপত্তাগত তাৎপর্য বহন করে না।
কিন্তু বাংলাদেশ তার অববাহিকায় একটি নদী প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশি কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার প্রতি ভারতীয় নিরাপত্তা স্টাবলিশমেন্ট যে অযাচিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে কেবল এটাই ফুটে ওঠে যে, একটি জাতি হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের কাছে তার মর্যাদা কতটা হারিয়েছে।
অনেকেই অনুমান করছেন যে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকায় তার গত সপ্তাহের সফরের মধ্য দিয়ে অসন্তোষের অবসান ঘটাতে পারেননি। তবে তার সফরের বিষয়টি বিভিন্ন মহল বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন । বাংলাদেশের কতিপয় অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক দাবি করেছেন যে, হর্ষবর্ধন শ্রীংলার সফর বরফ গলাতে পারেনি। বরং ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যে, তার প্রতি বাংলাদেশ শীতল আচরণ করেছে।
এই ধরনের অনুমান অবশ্য এই সন্দেহের বীজ বপন করেছে যে , বাংলাদেশ মৌলিকভাবে ভারত থেকে সরে গিয়ে চীনের প্রতি তার নীতি পরিবর্তন করেছে । আর সেটাই গণমাধ্যমে একটা বিরাট শোরগোল তৈরি করেছে।
শ্রেষ্ঠ দৃশ্যকল্প
সত্যিটা হলো , আওয়ামী লীগ এইসব অগ্রগতিতে খুব অসুখী ভাববে না নিজেকে। কারণ হাসিনা সরকার গণমাধ্যমের এই তোলপাড় থেকে তিনটি সুবিধা পেতে পারে ।
১. গণমাধ্যমের এই হাইপ চীনকে আশ্বস্ত করতে পারে এবং সে কারণে তারা নগদ অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে। আর সেটা বাংলাদেশের জন্য বেশ কাজের হবে।
২. ভারতীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে এই আকস্মিক মেরুদণ্ড শক্তিশালী করার বিষয়টিকে বাংলাদেশের জনগণ একটি ‘সমতামূলক অংশীদারিত্বের’ বিষয় হিসেবে দেখতে পারে। আর এটা দেখার জন্য আগ্রহী জনগণ সরকারকে সাধুবাদ দিতে প্রস্তুত রয়েছে ।
৩. এসব অ্যাকশনগুলোর মাধ্যমে ভারত তার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে উৎসাহিত হতে পারে ।এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা তার সর্বশেষ ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সেটাই বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে গেছেন।
কিন্তু কি ঘটতে পারে ?
তিনটি সম্ভাবনা রয়েছে।
১. বেইজিংয়ের এটা ভালভাবেই জানা আছে যে, টিকে থাকার জন্য হাসিনা সরকারের টাকা দরকার । তারা হয়তো এই টাকা দেয়ার বিষয়ে আগের থেকে একটু বেশি উদার হতে পারে ।কিন্তু তাদের এটা ভালোই জানা থাকবে যে যখনই দরকার পড়বে, তখন এই সরকার ভারতীয় স্বার্থ দেখতেই সর্বদা উদগ্রীব থাকবে এবং এই আনুগত্য স্ট্র্যাটেজিক কারণের চেয়ে বেশি।
২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরে বাংলাদেশ সরকারের দোদুল্যমানতা চীন ভুলে যাবে, এটা মনে করাটা সমীচীন হবে না । ভারত ব্যতিরেকে প্রতিটি উল্লেখযোগ্য শক্তি ওই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে ‘না’ করেছিল । আর তখন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরটির কাজ চীনকে দিয়ে দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বৈধতা আহরণের চেষ্টা করেছিল। আন্ত র্জাতিক সম্প্রদায় ধীরে ধীরে যখন বাংলাদেশের অনির্বাচিত সরকারের বাস্তবতা মেনে নিতে শুরু করল, তখনই দেখা গেল যে, মাতারবাড়ীর প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শেষ হয়ে এলো। যখন এটা চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাবে , তখনই ‘উচ্চমাত্রার সুদের হারের’ কথা বলে সরকার চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। এটা বুঝতে কারও কূটনৈতিক জিনিয়াস হওয়ার দরকার নেই যে বাংলাদেশে এই সিদ্ধান্তটা চাপের মুখে নিয়েছিল।
সুতরাং উল্লিখিত অভিজ্ঞতার আলোকে ঢাকার প্রতি বেইজিংয়ের নীতি নির্ধারণের বিষয়টি একটি সম্ভাব্য বাস্তবতা।
২. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাসীন দলের মিডিয়া প্রোপাগান্ডা মেশিনারি একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে ফেলবে। তারা দেখাতে চাইবে যে, শেখ হাসিনা কি করে ভারতকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষা তার কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। কিন্তু দলীয় অনুগত নেতাকর্মী ছাড়া ৪ বছরের শিশুকে এই গালগল্প খাওয়ানো যাবে না।
৩. ভারতীয় ল্যান্ডস্কেপে ঘটবে মজার ঘটনা। সেখানকার গণমাধ্যম এবং জনগণ তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিবে এই কথা বলে যে, যে এলাকাটিকে তারা তাদের ক্রীড়াক্ষেত্র মনে করে, সেখানেই চীনা হস্তক্ষেপ তারা দেখতে পাচ্ছে । কিন্তু ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ সাউথ ব্লকের অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের এটা বোঝাতে সক্ষম হবে যে, ঢাকায় তাদের সরকারটি টিকিয়ে রাখার জন্য বৃহৎ প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ কতটা প্রয়োজন। তাদেরকে এটাও বোঝাতে হবে যে, চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক প্রকৃত অর্থেই শুধু অর্থনৈতিক । কারণ বার্ষিক বাজেটে বড় ঘাটতি থাকা বাংলাদেশের শূণ্য ঝুড়ি পূরণ করার সামর্থ্য ভারত যথেষ্ট সীমিত রাখে।
মধ্যমেয়াদে হাসিনাকে অবশ্য তারা সন্তুষ্টির সঙ্গে এই ধারণা দিতে পারে যে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে যদি তার বিনিয়োগ চাহিদা পূরণ হয়, তাহলে তারা এরকম একটা ভূমিকা পালন করতে দিতে রাজী হতে পারে। এর বিনিময়ে তাকে ওইসব প্রকল্প অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে, যা ভারতের জন্য সংবেদনশীল। উল্লিখিত তথ্য যেহেতু সঙ্গতিপূর্ণ এবং এই বাস্তবতা সম্পর্কে সকল পক্ষই সচেতন । তাই বাংলাদেশ, ভারত এবং চীনের মধ্যকার সম্পর্কের বর্তমান স্থিতিবস্থা বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।