মেয়ে প্রমি কুমার ঘোষের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী (সাময়িক বরখাস্ত) অসিম কুমার ঘোষ। সরকারি কর্মচারী হয়েও দাফতরিক কাজ ঠিকমতো না করে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন ঠিকাদারি কাজ নিয়ে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও রয়েছে তার নামে। অসিম ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-৮ এর দায়িত্বে ছিলেন। এই পদসহ ওয়াসার বড় বড় পদে থেকে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছেন। মেয়ের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে ওয়াসার ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ, ঠিকাদারদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ওয়াসার নিজস্ব তদন্তে বিষয়গুলো প্রমাণিত হয়েছে। অসিম কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। কমিশনের যাচাই বাছাই শাখা অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য শিগগিরই কমিশনে উপস্থাপন করবে বলে দুদকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, অভিযোগ জমা হয়েছে সেটা যাচাই বাছাই শাখায় আছে। কমিশনে নথি উপস্থাপন করা হবে। কমিশনের অনুমোদনের পর অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অসিম কুমার ঘোষের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানার অস্ট্রাকি গ্রামে। ঢাকায় তিনি থাকেন মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। তিনি ১৯৯৭ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকা ওয়াসায় যোগ দিয়ে বর্তমানে ৫ম গ্রেডের বেতনের কর্মকর্তা। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যহার করে ঘুষ দুর্নীতি ও নিজের স্ত্রী ঝর্ণা রানী ঘোষের সহায়তায় অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। অসিম ও তার স্ত্রীর ঢাকায় ১৩টি বাড়ি ও প্লট আছে বলে অভিযোগে বলা হয়।
এরমধ্যে রাজধানীর ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও বসুন্ধরা রিভার ভিউ প্রকল্পে ৮টি প্লট ও আমুলিয়া গ্রীন মডেল টাউন ও কেরানীগঞ্জ তিনটি বাড়ি। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাগ হাউজিং এলাকায় বাড়ি নং-১, সেকশন-২, ব্লক-ডি, নম্বর বাড়িতে ফ্ল্যাট ও সলিমুল্লাহ রোডে ফ্ল্যাট আছে। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার করে বাড়ি করেছে কলকাতাতেও। তিনি একজন সরকারি কর্মচারী হওয়া সত্তে¡ও চাকরির বিধিমালা লঙ্ঘন করে কন্যা প্রমি কুমার ঘোষের নামে মেসার্স প্রমি এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। যার স্বত্বাধিকারি অসিম কুমার ঘোষের স্ত্রী ঝর্ণা রানী ঘোষ।
এছাড়াও তার আরও একাধিক বেনামী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঠিকাদারি কাজে ব্যস্ত থেকে ঠিক মতো অফিস করেন না। তাকে সেবামূলক কাজের জন্য অফিসে গিয়ে পাওয়া যায় না। ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে ওয়াসার এমডি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর শাহনাজ পারভীন মিতু। অভিযোগে তাকে দফতরে না পাওয়া, এলাকার জনসাধারণের অভিযোগ না শোনা, কাউন্সিলরসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মোবাইল ফোনে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
অনুসন্ধান ও ওয়াসার নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অসিম কুমার ঘোষ ঢাকা ওয়াসার মড্স জোন-৮ থেকে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৪০ লাখ টাকার বিভিন্ন মেরামত ও সংস্কার কাজের ঠিকাদারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নিজেই ঠিকাদারের ভূমিকায় ছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে কাজ না করেই বিল তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেন। এ কারণে ২০১৭ সালের ২০ জুন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তের আদেশে বলা হয়, ‘২০০৮ সাল থেকে ব্যবহৃত বিভিন্ন বিল রেজিস্ট্রিতে অসৎ উদ্দেশ্যে কার্যাদেশ নম্বর বাদ দিয়ে এন্ট্রি করে সংশ্লিষ্ট ইউডিকে জোরপূর্বক বাধ্য করেন। তিনি ২-৩ ট্রাক মাটি ফেলে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা বিল তুলে নেন। তিনি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাম্প মেরামতের নামে বিল তুলে নেন। বিনা অনুমতিতে বিদেশে অবস্থান করা সত্তে¡ও মেজারমেন্ট বহিতে স্বাক্ষর করেন। চাকরির শৃঙ্খলা পরিপন্থি নানা কাজের জন্য তাকে ঢাকা ওয়াসা থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।’
অসিমের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন ঠিকাদার লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কাছে। অভিযোগ অনুযায়ী খিলবাড়িরটেক পানির পাম্প হাউজের বাউন্ডারি দেয়াল ও রঙয়ের কাজ করিয়ে মেসার্স শাহানা অ্যান্ড কোং নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৮৫ হাজার টাকা, মেহেদী এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মডস জোন-৮ এর অফিস কম্পাউন্ডের বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণের জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, হাজীপাড়া পেট্রোল পাম্প হাউসের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ৯০ হাজার টাকা, মেসার্স বিপ্লব ট্রেডার্সের কাছ থেকে ওয়াসার মডস জোন-৮ সংস্কার মেরামত ও রঙয়ের কাজে এক লাখ টাকা ঘুষ নেন। মডস জোন-৮ এর অফিস ভবন মেরামত, সংরক্ষণ ও রঙয়ের ৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা কাজ না করে তুলে নেন।
মডস জোন-৮-এর পাম্প হাউসের মেরামত ও সংস্কারের ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, মডস জোন-৮ এর ডিএমএ সুইচ গেইটে বালু চেম্বার খুঁজে বের করা ও মেরামতের কাজের ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বোসান ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, মডস জোন-৮ থেকে বরিশাল এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকার কাজে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ আছে। অভিযোগগুলো ওয়াসার নিজস্ব তদন্তে প্রমাণিত হয়।
এছাড়াও অসিম কুমার ঘোষের দুটি পাসপোর্ট রয়েছে। যার একটির নম্বর ই-৮২২৮৭৫০। তিনি অপর একটি গোপন পাসপোর্টে সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্তে¡ও কোনো ধরনের জিও ছাড়া হরহামেশা ভারতে যান। ওই সময় তিনি বিপুল অংকের অর্থপাচার করেন-মর্মে অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে অসিম কুমার ঘোষ তার স্ত্রী ঝর্ণা রানী ঘোষ বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। তাদের নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে অসিম কুমারকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল দেয়া হয় গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে। প্রতিবার তিনি ফোন কেটে দেন। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।