স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইনানশিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিতে আইন করার প্রস্তাব বিরোধী দলের তীব্র বিরোধিতার মধ্যে পাস হয়েছে সংসদে। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধী সংসদ সদস্যদের তীব্র বাদানুবাদের মধ্যে বুধবার বিলটি পাস হওয়ার পর ওয়াকআউট করে প্রতিবাদ জানায় বিএনপি।
ওয়াকআউট না করলেও বিলটি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী যখন ভোটে দেন, তখন প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা ‘না’ ভোট দেন। বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হওয়ার আগে জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলো উত্থাপনের সময় এর প্রবল বিরোধিতা করেন বিরোধী সংসদ সদস্যরা।
‘কালো আইন’ আখ্যা দিয়ে বিলটি নিয়ে নিজেদের দেয়া সংশোধনী প্রস্তাবগুলো প্রত্যাহার করে নেন তারা। সংশোধনী উত্থাপনকারী সদস্যদের সবার একযোগে প্রস্তাব প্রত্যাহারের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে আর দেখা যায়নি।
সরকারের ব্যাংক ঋণের ভার অনেক বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের স্বশাসিত সংস্থাগুলোর স্থিতিতে থাকা ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা উন্নয়নের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা থেকে এই আইনটি করার উদ্যোগ নেয় সরকার।
রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এই অর্থ আনতে ‘স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইনানশিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাসমূহের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন’ গত বছরের সেপ্টেম্বরে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর আসে আইনসভায়। গত ১৫ জানুয়ারি বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কমিটি থেকে ফেরার পর বুধবার বিলটি পাসের জন্য যখন সংসদে প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বিলটি নিয়ে আলোচনার সময় জাতীয় পার্টির এক সংসদ সদস্য অর্থমন্ত্রীকে ‘ব্যবসায়ী’ বলেন। এতে ক্ষোভ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজেকে ‘বিশ্বের সেরা অর্থমন্ত্রী’ বলে দাবি করেন।
বিলে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা চালাতে যে খরচ হয় এবং নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বছরে যে অর্থ লাগে, তা তাদের নিজস্ব তহবিলে জমা রাখা হবে। এ ছাড়া আপৎকালীন ব্যয় নির্বাহের জন্য পরিচালন ব্যয়ের আরও ২৫ শতাংশ অর্থ এ সব সংস্থা সংরক্ষণ করতে পারবে। ওই সংস্থার কর্মীদের পেনশন বা প্রভিডেন্ড ফান্ডের অর্থও তারা সংরক্ষণ করবে।
বাকি অর্থ কোষাগারে আনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সংস্থাসমূহের তহবিলে রক্ষিত উদ্বৃত্ত অর্থের মালিকানা প্রকৃতপক্ষে জনগণের এবং সেই কারণে উক্ত অর্থ জনগণের কল্যাণ সাধনে ব্যবহার করা সমীচীন।’
বিলের উপর আলোচনায় বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, আর্থিক খাতে লুটপাটের কারণে এখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর অর্থের দিকে চোখ পড়েছে সরকারের। তিনি বলেন, ‘সরকার রাজস্ব থেকে কেন উন্নয়ন করতে পারে না? শেয়ারবাজার লুট, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ, প্রকল্পের নামে সীমাহীন লুটপাট হচ্ছে।’
‘টাকা ব্যাংকে আছে। সেই টাকা নিয়ে নিলে শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ব্যাংকের হাতে টাকা থাকবে না। সরকারের এখন চোখ গেছে এ সব প্রতিষ্ঠানের দিকে।’
রুমিন বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সাধারণ অবস্থা থেকে ব্যবসায়ী হয়েছেন। উনি অর্থনীতি বোঝেন না, এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। তাহলে সমস্যটা কোথায়? “উনার সদিচ্ছার অভাব। এত মেধাবী তিনি কিন্তু শেয়ারবাজার, খেলাপি ঋণ নিয়ে কিছু করলেন না। কেন মেধাবী অর্থমন্ত্রী এ দিকে নজর দিচ্ছেন না। কেন খেটে খাওয়া মানুষের দিকে উনার নজর নেই?’
জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, ‘কদিন পরে আমার অ্যাকাউন্টের টাকা নিয়ে নেবে কি না, সেই ভয়ে আছি। টাকা এখন ব্যাংক থেকে নিয়ে বাসায় নিয়ে যাবে কি না, ভাবছি।’
‘আমি এটুকু বলতে চাচ্ছি, অর্থমন্ত্রী শিক্ষিত লোক। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। উনার সময়ে পুঁজিবাজারে ১০ হাজার ইনডেক্স উঠেছিল। যখন উনি পরিকল্পনামন্ত্রী। তখনই তিনি বলেছিলেন, ৪ হাজার হওয়ার কথা, কীভাবে ১০ হাজার হল? উনি জানতেন না? ব্যাংকের মালিক সমিতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রী বসেন। কীভাবে হয় এটা? নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতা দেখাবেন না। পৃথিবীতে অনেক দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে,’ সরকারের উদ্দেশে বলেন তিনি।
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, ‘এটা একটা কালো আইন। আইন করে সমস্ত টাকা তুলে নেবে। উন্নয়নের জন্য অর্থ দরকার আছে। কিন্তু সামর্থ্য কতটুকু? এই টাকাগুলো ব্যাংকে জমা আছে। টাকা নেয়া হলে ব্যাংকগুলো মারাত্মক বিশৃঙ্খলায় পড়বে। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্পৃহা ধ্বংস হয়ে যাবে।’
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘বিলটি পাস হলে অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে যাবে। এই টাকার মালিক জনগণ। পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার করেন। ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়েছে, সেদিকে নজর দিন।’
তিনি বলেন, “টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে এর জন্য ব্যাংক দায়ী। সালমান এফ রহমান এখানে আছেন, তিনি ব্যাংকের মালিক। ব্যাংকের মালিক জনগণ। ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন এখানে বই দেয়, ওখানে কম্বল দেয়, অন্তত ১০০ ছবি দেয়। অর্থমন্ত্রীর ছবি ছাপা হয় না। টাকা কি উনার? এটা জনগণের টাকা। এই টাকা কেন অ্যালাউ করেন। টাকা যদি বেশি হয়ে থাকে জনগণের খেদমতের জন্য দিয়ে দেন।“
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ী হলে যা হয়, তাই হয়েছে। আমি একজন অ্যাডভোকেট, এটা বললে কি অপরাধ হবে?’
জাতীয় পার্টি শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘নবীরোধী এ আইন পাস হলে সংসদের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটবে। ব্যাংক থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। দেখা যাবে সামনের বছর ১ লাখ কোটি টাকা নেবেন। ’
পাস হওয়া বিলে মোট ৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেয়া হয়েছে, যাদের উদ্বৃত্ত অর্থ এখন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আসবে।
সেগুলো হল- জাতীয় কারিকুলাম এবং টেক্সটবুক বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ‘ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, দিনাজপুর উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বার্ড, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি-বগুড়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট, বিএসটিআই, বিআইডিএস, বার্ক, জাতীয় স্থানীয় সরকার ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বিএডিসি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাজউক, সিডিএ, কেডিএ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সেরিকালচার বোর্ড, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, বিএমডিএ, বেপজা, বিটিএমসি, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, পেট্রোবাংলা, শিপিং কর্পোরেশন, ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ, জুট মিল কর্পোরেশন, বিআরটিসি, বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, চা বোর্ড, পর্যটন কর্পোরেশন, বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, আরইবি, বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন।