টিসিবির ‘ফ্যামিলি কার্ড’ কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী এক কোটি পরিবারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর নগদ অর্থ সহায়তা পেয়েছেন ৩৮ লাখ ৫০ হাজার সুবিধাভোগী। তাদের সবাই পাচ্ছেন ফ্যামিল কার্ড। এছাড়া নতুন যুক্ত হয়েছে আরও ৬১ লাখ ৫০ হাজার পরিবার। আজ ১৫ মার্চ থেকে এই কর্মসূচি শুরু হবে। যারা সরকারের ১২৩ ধরনের ভাতার সুবিধা পাচ্ছেন না, কেবল তারাই টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। ফ্যামিলি কার্ড কর্মসূচিসহ রমজানে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রিতে মাঠ পর্যায়ের কমিটিগুলোকে সহায়তার নির্দেশ দিয়েছেন বাণিজ্য সচিব (সিনিয়র) তপন কান্তি ঘোষ। রোববার অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত বৈঠক থেকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্যারিফ কমিশন, যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা। সংস্থাগুলোর প্রধানরা আঞ্চলিক প্রধানকে নির্দেশ বাস্তবায়নের আদেশ দেবেন।
এদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বাজারে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন হচ্ছে যুদ্ধের সময় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের এই উদ্যোগ কতটা কাজে আসবে। তাদের মতে, টিসিবির পণ্যের কাভারেজ এলাকা বাড়ানো, গরিব মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য সহায়তা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।
কারণ যুদ্ধের অজুহাতে পর্যাপ্ত পণ্য থাকার পরও একটি চক্র তা গুদামজাত করে দাম বাড়াচ্ছে।
টিসিবির এই কর্মসূচি কতটা বাজারে প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম হোসেন বলেন, টিসিবি এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়মূল্যে পণ্য দেবে। এর অর্থ-উপকৃত হবে ৫ কোটি মানুষ। অর্থাৎ প্রতি পরিবারে ৫ জন সদস্য উপকৃত হবে। এখন প্রশ্ন স্থানীয় বাজার থেকে কিনে এ পণ্য বিতরণ করলে সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নতি হবে না। যদি দেশের বাইরের উৎস থেকে এনে পণ্য দেওয়া হয় তবে সরবরাহব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে। বাজারে মূল্যের ওপর প্রভাব পড়বে। তবে এটি ভালো উদ্যোগ। এ কার্যক্রম আরও জোরদার করতে পারলে ভালো হবে।
টিসিবির এই কর্মসূচি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ করা হবে। এর জন্য পৌনে ২ কোটি লিটার ভোজ্যতেল, ১৯ হাজার টন মসুর ডাল, ১৪ হাজার টন চিনি ও ১০ হাজার টন ছোলা কেনার প্রস্তাব সম্প্রতি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ওই সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, টিসিবি অর্থনীতির মেরুদণ্ড। ভোক্তার কাছে সময়মতো ন্যায্যমূল্যে পণ্য পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ। টিসিবিকে আরও কার্যকর করে গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে টিসিবিকে নিয়ে যাওয়া হবে। এ সংস্থাকে সক্রিয় করার ফলে যারা সিন্ডিকেট করে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে না। টিসিবিকে কার্যকর করে সাধারণ ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে পারলে দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না।
সূত্রমতে, এই কর্মসূচি পরিচালনার জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) মেঘনা সুগার রিফাইন্ড লিমিটেড এবং সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিক টন চিনি কিনতে যাচ্ছে। এছাড়া সেনা কল্যাণ সংস্থার কাছ থেকে ২ হাজার টন মেসার্স ব্লু স্কাই এন্টারপ্রাইজ থেকে ৪ হাজার টন এবং রুবি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের কাছ থেকে ৪ হাজার টন ছোলা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইজ সার্ভিসেস লিমিটেড, পরবো ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স রায় ট্রেডার্স, প্লানটেজিক ইনকরপোরেশন, বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড ও বসুমতী ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড থেকে ১৯ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন মসুর ডালও কেনা হবে। সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সুপার অয়েল রিফাইন্ড লিমিটেড, মেঘনা এডিবল অয়েলস রিফাইনারি লিমিটেড, সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড, বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড ও শুন শিং এডিবল অয়েল লিমিটেডের কাছ থেকে ১ কোটি ৭১ লাখ ১৫ হাজার ৬৫২ লিটার সয়াবিন তেল কেনা হবে। কেনাকাটার এ প্রস্তাব সম্প্রতি সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে।
সূত্র জানায়, কোটি পরিবারকে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়মূল্যে ৫টি পণ্য দেওয়া হবে। একসঙ্গে ১৪ কেজি ওজনের এই ৫ পণ্যের প্যাকেট পাবেন কার্ডধারীরা। প্রতি প্যাকেটে থাকবে ২ লিটার ভোজ্যতেল, ২ কেজি চিনি, ২ কেজি ছোলা, ২ কেজি মসুর ডাল ও ৫ কেজি পেঁয়াজ। ক্রেতারা পাচ্ছেন প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১১০ টাকায়, প্রতি কেজি চিনি ৫৫, মসুর ডাল ৬৫, পেঁয়াজ ৩০ টাকা। ছোলার দাম এখনো নির্ধারণ হয়নি।
একজন কার্ডধারী রোজার আগে এবং রোজার মধ্যে দু’দফা পণ্য পাবেন। প্রথম কিস্তির পণ্য পাবেন ১৫ মার্চ থেকে। ঢাকা মহানগরী ছাড়া জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে উপকারভোগীরা কার্ড দেখিয়ে পণ্য তুলতে পারবেন টিসিবির ডিলারদের কাছ থেকে। দ্বিতীয় কিস্তির পণ্য দেওয়া হবে রোজার মাঝামাঝি সময়ে। আগের মতো টিসিবির পণ্যের জন্য লাইনে ধাক্কাধাক্কি করতে হবে না। একই ব্যক্তি প্রতিদিন লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য নিতে পারবেন না। শুধু ওয়ার্ড কাউন্সিলররা ওয়ার্ডভিত্তিক যেসব গরিব-অসহায়-নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা তৈরি করেছেন, তারাই পণ্য তুলতে পারবেন।
জানা যায়, এই কর্মসূচি পরিচালনা করতে প্রয়োজন হবে ২ কোটি লিটার সয়াবিন তেল, ৪০ হাজার মেট্রিক টন চিনি, ৪০ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল ও ৪০ হাজার মেট্রিক টন ছোলা এবং ২৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, আগে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিসিবির পণ্য যেত না। প্রয়োজন হলে জেলা পর্যায় থেকে পাঠানো হতো। কিন্তু এবার ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত টিসিবির পণ্য বিতরণ করা হবে। রোজায় যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে, এজন্য আগেই এটা শুরু হচ্ছে। ঢাকায় কার্ড দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আগের মতোই ট্রাকে করে বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে মোট ১৮৫টি ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিদিন চার ধরনের পণ্য প্রতিটি ট্রাকে থাকছে ২ হাজার ৫০০ কেজি করে। ঢাকা শহরে ১২ লাখ পরিবারকে এই পণ্য দেওয়া হচ্ছে। ঢাকার বাইরে পাচ্ছে ৮৮ লাখ পরিবার। তারা ২০ এপ্রিল পর্যন্ত মোট দুইবার পাবেন।
এবার পণ্য নিতে এসে কেউ বিশৃঙ্খলা করতে পারবে না। যারা কার্ডধারী, শুধু তারাই পণ্য পাবেন। পণ্য দেওয়ার পর ক্রেতার ওই কার্ডে লিখে দেওয়া হবে আমি পণ্য বুঝিয়ে দিলাম। ক্রেতা টিসিবির ডিলারের কার্ডে লিখে দিবেন, ‘আমি পণ্য বুঝিয়ে পাইলাম’।