পৃথিবীর সকল পিতামাতা নামক জোড়া বৃক্ষের কলি হয়ে সযত্নে প্রস্ফুটিত হওয়া ফুল গুলোকে যত্ন করে ধরণীর বুকে যিনি সুবাস ছড়ানোর উপযুক্ত করে তোলেন তিনি হলেন শিক্ষা গুরু, মহান আদর্শবান শিক্ষক। তাই জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভার বলেছেন, শিক্ষক শুধু মহান শব্দ নয় বরং মহান প্রতিশ্রুতি।সততা,নৈতিকতা, দেশপ্রেম, পরোপকার এবং আদর্শ চরিত্রবান মানুষ হওয়ার মূল ভিত্তি হলো সুশিক্ষা। উন্নত জাতি গঠন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের গুণগত শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, প্রত্যেক শিশুই অনন্ত শক্তির অধিকারী, সেই সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। যে কাজটি শিক্ষক সব বাধা অতিক্রম করে সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করেন, যেন শিশুর জীবন ও চরিত্র গড়ে ওঠে প্রকৃত মানুষ হিসেবে! শিক্ষকরা স্ব-মহিমায় বিশুদ্ধ জ্ঞান, মানবিক আর নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং দীক্ষিত করে গড়ে তোলেন দেশের যোগ্য নাগরিক। শিক্ষা যেহেতু জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষকরা হচ্ছেন এই মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর। এ সমাজের মধ্যে নৈতিক বিচারে শিক্ষকদের চেয়ে সম্মানিত এবং শিক্ষকতার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা দ্বিতীয়টি নেই। এই কথাটা ভাববার এখন আর উপায় নেই। করণ দেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। মাধ্যমিকের শিক্ষকরা তাঁদের বেতন-ভাতা নিয়ে মোটেই সন্তুষ্টনন, হতাশাগ্রস্ত ।যেই দেশে গৃহকর্মী বেতন পান ৩০,০০০ টাকা অথচ সেই দেশে জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকের বেতন ১২,৫০০ টাকা! এই দৃশ্য দেখার পর জাতি গড়ার দায়িত্বটা কে নিবে? ফলে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আসার আগ্রহ দিন দিন একেবারেই কমে যাচ্ছে । কারণ বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন অত্যন্ত নিম্নমানের। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ফিনল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন এবং এশিয়ার সৌদি আরবসহ বেশ কিছু দেশের শিক্ষকরা অনেক বেশি বেতন পান। প্রতিবেশী দেশ ভারতের শিক্ষকরাও বাংলাদেশের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি বেতন পান। আমাদের দেশে সরকারি প্রাথমিক ও এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন যেখানে ১৪০০ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকায় শুরু, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা থেকে।দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষকরা একদম পিছিয়ে। বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেতন-ভাতা ও মর্যাদার দিক থেকে বাংলাদেশের শিক্ষকরা অনেক পিছিয়ে।
প্রাথমিক পর্যায়ে সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা পান এটা জাতীর জন্য লজ্জাজনক। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য থাকবে কেন? সরকারি -বেসরকারি সকল শিক্ষককেই সমান বেতন প্রদান করা উচিত।শিক্ষকের অসীম মর্যাদা বোঝাতে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ লিখেছিলেন ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি' যার প্রতিটি শব্দ আজ মলিন হতে চলেছে। কেননা এই দেশের শিক্ষকরা সামান্য বেতন ভাতা পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। শিক্ষাগুরুর কাঁন্নায় আজ রাজপথ প্লাবিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শিক্ষকরা অধিক বেতন পেয়ে সম্মানিত হন আর বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির জন্য করতে হয় আন্দোলন, ঝরাতে হয় রক্ত, দিতে হয় প্রাণ! বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রারম্ভিক মাসিক বেতন প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৩৫ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ২৭ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৩ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৬৩ হাজার টাকা।
মাধ্যমিকে বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন সর্বসাকুল্যে ১৪ হাজার টাকা, ভারতে ৪০ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩২ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৯ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৯০ হাজার টাকা! উন্নত শিক্ষার জন্য ভালো শিক্ষানীতির যেমন দরকার তেমনি ভালো শিক্ষক, কাঠামো ও পরিবেশও দরকার। নীতির পরিবর্তন কার্যকর হতে পারে তখনই যখন এই পরিবর্তনের কারিগরদের শিক্ষা, দক্ষতা ও জীবনমান উন্নত হবে। তাদের সম্মান, সামাজিক মর্যাদা, অবস্থান অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে উপরে হবে। উন্নত মেশিনেই উন্নত পণ্য তৈরি হতে পারে। শিক্ষকতার পেশাকেও তেমনি উন্নত ও আকর্ষণীয় করতে হবে! জাপানে সবচেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষার নিম্নমাধ্যমিক স্কুলের একজন শিক্ষক প্রতি বছর বেতন ২৪ লাখ ৬৫ হাজার ৭৬৫ টাকা (২৯,০০৯ ডলার), সে হিসেবে মাসিক বেতন হয় প্রায় ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮০ টাকা (২০১৫’র হিসেবে)। একই শিক্ষক তার জীবনে বেতন বৃদ্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে ২০১৫’র বেতন স্কেল অনুযায়ী বছরে আশা করতে পারেন ৫৩ লাখ ৭৩ হাজার ২৭৫ টাকা (৬৩,২১৫ ডলার), সে হিসেবে তার মাসিক বেতন দাড়ায় ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭২ টাকা। শিক্ষকের বেতন দেশের সর্বত্রই প্রায় অভিন্ন! শিক্ষকদের বেতনের দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে লুক্সেমবার্গ। ইউরোপের এ দেশটির প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৫ হাজার ৯৮৪ ডলার ৩০ সেন্ট। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষকের সম্মান ও মর্যাদা অন্যান্য পেশার তুলনায় অনেক উপরে। আর আমাদের দেশে শিক্ষকের মর্যাদা কথাটা দেশের অভিজাত শ্রেণির কাছে একটি তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাদের কাছে শিক্ষকের মর্যাদা একটি মিথ্যা ফানুস ছাড়া আর কিছুই নয়। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা মালয়েশিয়ায় শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে।এবং আন্তর্জাতিকভাবে যে সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়, সেখানে এই দেশের ছাত্র-ছাত্রীরাই সবচেয়ে ভালো করে ।তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এই সব দেশে শিক্ষকের প্রচুর মর্যাদা ও ভালো মানের বেতন ব্যবস্থা রয়েছে বলে ভালো শিক্ষক পাওয়া যায় এবং তাদের ধরে রাখাও সহজ হয়। অথচ এই দেশে শিক্ষকগণের বেতন বিশ্বের প্রায় সকল দেশের চেয়ে নিম্নমানের যার ফলে এই দেশে জাতিগড়ার কারিগরদের মান-সম্মান সামাজিক মর্যাদা আজ বিপন্ন।কোনো সন্দেহ ছাড়াই আমরা এখন বলতে পারি, শিক্ষককে মর্যাদা প্রদান করা কোনো নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটা যে কোনো দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য জরুরী। তাই উন্নত বিশ্বে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় দেশের সম্পদ প্রিয় শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ অবস্থানে আনায়নে শিক্ষাগুরুর অন্তকাঁন্না বন্ধ করতে হবে অর্থাৎ দেশের প্রাথমিকের শিক্ষকগণের বেতন গ্রেড উন্নয়ন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সকল বেসরকারি বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয় গুলোকে জাতীয়করণ করে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সাথে সাদৃশ্য রেখে উচ্চতর বেতন কাঠামো ঠিক করে শিক্ষাগুরুর মর্যাদ সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করতে পারলেই বিশ্বের বুকে দেশে ও জাতির মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, বন্ধ হবে শিক্ষাগুরুর অন্তকাঁন্না আর সমৃদ্ধ হবে জাতি।
লেখকঃ মোঃ উজির আলী, প্রধান শিক্ষক, নড়াইল কালেক্টরেট স্কুল