দেশের সব নদ-নদীতে দখলদাররা থাবা বসিয়েছে। তাদের বিষাক্ত থাবায় ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে নদ-নদী ও খালগুলো। ৫৩ জেলার ২৩০টি নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজার ৭৬২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এদের উচ্ছেদ করার পরও ফের দখলের ঘটনা ঘটছে। কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছে হাতবদল।
দখলদারদের পেছন আছেন ১১৮ প্রভাবশালী ব্যক্তি। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের অসাধু নেতাকর্মীরাও আছেন। সম্প্রতি সরকারের একটি সংস্থা নদী দখলদার ও তাদের পরিচয় চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।
এর সঙ্গে চার ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ৮৯ পৃষ্ঠার সংযোজনীও দেয়া হয়েছে। দখল রোধে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ ৬ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। ভূমি ও নৌসচিবের দফতরেও এ সংক্রান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। ঢাকার চারপাশের নদী দখলদারদের মতো প্রভাবশালীদের আমরা কোনো ছাড় দেইনি।
তেমনি সারা দেশেও কাউকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও ইউনওদের নির্দেশনা দিয়েছি। নদী দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে নদ-নদীর সংখ্যা ২৩০টি। দখল হওয়া নদী ও খালের সংখ্যাও ২৩০টি। এতে উল্লেখ করা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থান, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নদী ও খালের তীরবর্তী স্থান দখলে নিয়ে বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর তীরবর্তী স্থানে অবৈধভাবে হাটবাজার বসানো হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে উচ্ছেদ অভিযানের পর রাজনৈতিক ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ দখলদারদের ফের দখলে সহায়তা করছে।
নদী-খালের জমি দখলদারদের সঙ্গে স্থানীয় ভূমি অফিস ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ থাকে। ফের দখলের ক্ষেত্রে এ ধরনের চক্রের সহায়তা কাজে লাগানো হয়। নদীদখলে ক্ষমতাসীন দলের অসাধু নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য থাকায় জনগণের মধ্যে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে নদী-খাল দখলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নদনদী, খাল ও বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
নদনদী সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষাকালে পানির প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়। এতে জনগণের ফসল ও ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়।
নদী-খাল দখলদারদের সঙ্গে সরকারি অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নদী দখলদারদের সঙ্গে স্থানীয় ভূমি অফিস ও বিআইডব্লিউটিএ’র অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগাসাজশ রয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন স্থানে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর যথাযথ কর্তৃপক্ষ নিয়মিত মনিটরিং না করায় ফের দখল হয়ে যাচ্ছে।
তবে নদী দখলদারদের সংখ্যা অনেক বেশি বলে দাবি করেছেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। তিনি বলেন, আমাদের প্রথম তালিকায় নদী দখলদারদের সংখ্যা ৪৯ হাজার ১৬২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। দখলদারদের দ্বিতীয় তালিকা করছি। সেখানেও কয়েক হাজার দখলদারের নাম আসবে।
কোন জেলায় কত দখলদার : দেশের ৫৩টি জেলায় ২৩০টি নদী-খাল দখল করেছে ১০ হাজার ৭৬২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতাকারী প্রভাবশালীদের সংখ্যা ১১৮ জন। সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ১৬০ জন দখলদার আছে ময়মনসিংহে। এ জেলার দখলদাররা ৫৯টি নদী-খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে।
দ্বিতীয় অবস্থানে খুলনা। এ মহানগর এলাকায় ১ হাজার ২২৯ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ২টি নদীর বিভিন্ন অংশ দখল করেছেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন ২ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। আর মহানগর বাদে খুলনা জেলায় ৭টি নদী-খালে দখলদার রয়েছে ৮৯ জন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। এ জেলায় দখলদারদের যারা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে তারা সংখ্যায় ৬ জন।
৬০টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ঢাকা জেলা ও মহানগর এলাকায় নদী দখল করেছে। এদের পৃষ্ঠপোষক ৮ জন। অন্য জেলার মধ্যে গাজীপুরে ৪টি নদীতে ৪১, টাঙ্গাইলের ৫টি নদীতে ৭৪, কিশোরগঞ্জের ১০টি নদীতে ১১৯, নারায়ণগঞ্জের ৫টি নদীতে ১৬৬, মানিকগঞ্জের ৪ নদীতে ২৬, মুন্সিগঞ্জের ৫ নদীতে ৪২, নরসিংদীর ১ নদীতে ১৪, ফরিদপুরের ৩ নদীতে ৮ এবং রাজবাড়ীর ৪ নদীতে ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখল করেছে।
বাকি জেলাগুলোর মধ্যে গোপালগঞ্জের ২ নদীতে ৪৩১, শরীয়তপুরে ১১ নদীতে ১২১, জামালপুরে ৭ নদীতে ১৯৫, শেরপুরে ৭ নদীতে ১৭৭, নেত্রকোনায় ১ নদীতে ২৫, সিলেটে ২ নদীতে ১৯১, মৌলভীবাজারে ৪ নদীতে ১৮৩ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখলদার হিসেবে আছে। হবিগঞ্জের ১ নদীতে ৩২, সুনামগঞ্জের ৮ নদীতে ১৮৮, চট্টগ্রামের ২ নদীতে ৭৯, কুমিল্লার ২ নদীতে ৩৭৩, ফেনীর ১ নদীতে ৩৯, চাঁদপুরের ৩ নদীতে ৭৪৪, রাঙ্গামাটির ১ নদীতে ৫৩, বান্দরবানের ১ নদীতে ৪৫, রংপুরের ৪ নদীতে ১৬৫, দিনাজপুরের ১ নদীতে ৭৭৬, পঞ্চগড়ের ২ নদীতে ১৪, নীলফামারীর ৪ নদীতে ১১, ঠাকুরগাঁওয়ের ১ নদীতে ২২৯, রাজশাহীর ১ নদীতে ১১ ও বগুড়ার ১ নদীতে ২৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখল করে আছে।
পাবনার ২ নদীতে ২৯৭, সিরাজগঞ্জের ২ নদীতে ৫৫, নওগাঁর ২ নদীতে ১০৩, নাটোরের ২ নদীতে ৪৬৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১ নদীতে ৫২, সাতক্ষীরার ৩ নদীতে ১০৮, বাগেরহাটের ৫ নদীতে ২৬৩, যশোরের ১ নদীতে ২৭, নড়াইলের ৩ নদীতে ৮২, কুষ্টিয়ার ৪ নদীতে ১৭৯, ঝিনাইদহের ৫ নদীতে ১৩৪, মাগুরার ৩ নদীতে ৫৪, বরিশালের ২ নদীতে ৩৯, ঝালকাঠির ৫ নদীতে ১১, পিরোজপুরের ৩ নদীতে ২৭, বরগুনার ২ নদীতে ১০ এবং পটুয়াখালীর ৫ নদীতে ৬১৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখলদার রয়েছে।
সারা দেশে একযোগে অভিযানের সুপারিশ : প্রতিবেদনে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে নদী উদ্ধার করতে সারা দেশে একযোগে ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনাসহ ৬টি সুপারিশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, উচ্ছেদ অভিযানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।
নদী ও খাল দখলকারীদের পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সতর্ক করা যেতে পারে। এমনকি সরকারি দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকেও তাদের সতর্ক করা প্রয়োজন।
এতে আরও বলা হয়েছে, নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ভূমি অফিস, বিআইডব্লিউটিএ ও স্থানীয় প্রশাসনকে আরও সক্রিয় করা এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর তা নিয়মিত মনিটরিং এবং প্রয়োজনে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা যেতে পারে।