বাঙালির অফুরান শক্তির অন্যতম উৎস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালির জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’কে ঘিরে তাই ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। এ উপলক্ষে রাজধানীকে সাজানো হয়েছে অনন্য এক উৎসবের আমেজে। বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের নানা আলোকচিত্র শোভা পাচ্ছে রাজধানীর সড়কের পাশে ও সড়কদ্বীপগুলোতে। বিজয় সরণিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর উক্তিসংবলিত প্রতীকী ৬০ ফুট উচ্চতার হিমালয় তৈরি করা হয়েছে।
রাজধানীজুড়ে ব্যানার ও ফেস্টুন দিয়ে সাজানোর পাশাপাশি ডিজিটাল প্রদর্শনী, ধানমণ্ডি, জাতীয় সংসদ ভবন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বিমানবন্দর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আলোকসজ্জার আয়োজন করা হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বর্ণিল এসব সাজসজ্জা চোখে পড়েছে। সর্বত্র বাঙালির অনুপ্রেরণার মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। রাজধানী সেজেছে মুজিবীয় সাজে। প্রদর্শনীর আয়োজনের পাশাপাশি অনেক এলাকায় ১৭ই মার্চ জন্মদিনের আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার চলছে। সাজসজ্জাকে ঘিরে দর্শনার্থীদের ভিড় লক্ষ করা গেছে। বিজয় সরণি ও সংসদ ভবন এলাকায় দুই দিন ধরে বিকেল হতেই মানুষের ঢল নামছে। বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর উক্তিসংবলিত প্রতীকী ৬০ ফুট উচ্চতার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ঘিরে সারা দিনই দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা গেছে। সবাই ওই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও কিউবা ছিল। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাত্ হয়। কাস্ত্রো সে সময় বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এক্সপেরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।’ অর্থাৎ ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’
অসংখ্য দর্শনার্থী প্রতীকী ৬০ ফুট উচ্চতার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখছে আর সেই ন্যাম সম্মেলনে ফিরে যাচ্ছে। একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা মোবারক আলী বলেন, ‘রাজধানীর সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আছি। ফিদেল কাস্ত্রো যেন আমাদের সামনেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন।’
রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে কথা হয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল ছাত্রের সঙ্গে। তাঁরা দল বেঁধে মুজিববর্ষের সাজসজ্জা দেখতে এসেছেন। তাঁরা বলেন, পুরো রাজধানীতেই এক অন্য রকম পরিবেশ। খুবই ভালো লাগছে। প্রদর্শনীগুলো দেখে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারছি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো শুনতে পাচ্ছি।
সংসদ ভবন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সংসদের লবি ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় নৌকার ওপর বঙ্গবন্ধুর পোর্ট্রেটসংবলিত প্ল্যাকার্ড স্থাপন করা হয়েছে। আশপাশের সড়কগুলো ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় পিক্সেল ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের ভাষণের উদ্ধৃতি ও বিভিন্ন মুহূর্ত দেখানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সেখানে ১৯৫২ থেকে শুরু করে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাগুলো তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া আলোকসজ্জার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠবে। সঙ্গে থাকবে লেজার শো। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠানের কিছু অংশ এখানেই দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, মুজিববর্ষ উদ্যাপনে জাতীয় কমিটির বাইরে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সংসদের বিশেষ অধিবেশন ছাড়াও সাজসজ্জার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সংসদ ভবনকে ঘিরে আলোকসজ্জার পাশাপাশি নানা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া দৃষ্টিনন্দন লেজার শোর আয়োজন থাকছে।
এরই মধ্যে সংসদ ভবনে সাজসজ্জার কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে লাইটিং ও লেজার শোর মাধ্যমে ভেসে উঠছে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা। সংসদের লেকের মাঝখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই আঙুল উঁচিয়ে দেওয়া ভাষণের প্রতিচ্ছবি লেজার শোর মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া সংসদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের মাঠে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার। সংসদ ভবনের লেকের পারে প্রতিটি দেয়ালে লাইটিংয়ের মাধ্যমে নৌকার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া সংসদে প্রবেশের প্রতিটি পথ বিভিন্ন রঙের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে।
সংসদ চত্বরে পুরো অনুষ্ঠান সাজানোর কাজ পেয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি। এর কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ জানান, জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানটি রেকর্ডিং হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানমালা সংসদের স্থাপিত প্রজেকশনের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পাঁচ থেকে সাত মিনিটের আতশবাজি, ফায়ারওয়ার্কস ও লেজার শো। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলবে অনুষ্ঠানটি। তবে অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। নির্ধারিত গণমাধ্যম এই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আগামী বছরের ১৭ই মার্চ পর্যন্ত রাজধানী ছাড়াও জেলা ও উপজেলায় ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রদর্শনীর আয়োজন থাকছে। সেখানে স্থাপন করে নতুন নতুন কনটেন্ট সরবরাহ ও প্রচার করা হবে। সারা দেশে এক হাজার ডিজিটাল ডিসপ্লে স্থাপন করে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওপর কনটেন্ট প্রচার করা হচ্ছে। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে অডিও ভিজ্যুয়াল প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অন্যান্য বিমানবন্দরের ভেতরে-বাইরে সাজসজ্জা যাত্রীদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। বিমানবন্দরগুলোতে বর্ণিল আলোকসজ্জা, প্রজেক্টরে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, ওয়ালপেপার, বিলবোর্ড বসানো হয়েছে। শাহজালালে সর্বকালের সেরা ব্র্যান্ডিং ও সাজসজ্জার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বিমানবন্দরের বাইরের অংশ থেকে শুরু করে প্রতিটি বোর্ডিং ব্রিজে লাগানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি এবং তাঁর জীবনচিত্র। প্রজেক্টর বা ডিজিটাল স্ক্রিন স্থাপন করে সেগুলোতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে বিলবোর্ডে। পুরো বিমানবন্দরে বর্ণিল আলোকসজ্জা করা হয়েছে।
এ ছাড়া রাজধানীর ব্যাংকপাড়া মতিঝিলেও রয়েছে বর্ণিল আয়োজন। সুউচ্চ ভবনগুলোতে আলোকসজ্জা ছাড়াও নানা সাজসজ্জা করা হয়েছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও জীবনচিত্র সেখানে ফুটে উঠেছে।
রাজধানীজুড়ে কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। মোড়ে মোড়ে সতর্ক অবস্থায় দেখা গেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরকে ঘিরে নিরাপত্তা একটু বেশি। সেখানে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশিষ্টজনরা শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণে আতশবাজি প্রদর্শনী ও ফানুস উত্তোলনের কর্মসূচি রয়েছে। ধানমণ্ডি ছাড়াও রাজধানীর রবীন্দ্রসরোবর, হাতিরঝিল, ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি ও জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় আতশবাজি প্রদর্শনী হবে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণে আতশবাজির মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। তিনি বলেন, বড় ধরনের জনসমাগম পরিহার করে উত্সবমুখর পরিবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করতে হবে। সে জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই উত্সবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে।