• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ১ মে, ২০২০ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

বাংলাদেশে লকডাউনে কতটা লাভ, কতটা ক্ষতি?

বিবিসি বাংলা

করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশে একমাসেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ ছুটি এবং বহু এলাকায় লকডাউন চলছে। সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় এখন পর্যন্ত দেশের ৬০টি জেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে কঠোর লকডাউনের সুফল যেমন রয়েছে তেমনি দেশব্যাপী এই অচলাবস্থার কারণে লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের অর্থনীতি।

বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে মাদারীপুরে। ১৯শে মার্চ শিবচর উপজেলা লকডাউন করা হয়। আইইডিসিআর এর তথ্যে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত পুরো মাদারীপুর জেলায় মোট আক্রান্ত ৩৮জন। জেলার সিভিল সার্জন জানান, শিবচরে আক্রান্ত ১৯ জনের মধ্যে ১২জনই সুস্থ।

লকডাউন কী আসলে কাজ করেছে?
কার্যকর লকডাউন যে সংক্রমণ ঠেকাতে সহায়তা তার একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে টোলারবাগ।

সারাদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণার আগেই রাজধানীর টোলারবাগ এলাকা লকডাউন করা হয়। আইইডিসিআর এর সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে সমগ্র ঢাকায় ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে ১২ই এপ্রিলের পর টোলারবাগে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, শিবচর, টোলারবাগের মতো যেসব এলাকায় কার্যকরভাবে লকডাউন পালিত হয়েছে সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। "নির্দেশনায় কিন্তু আছে যে গণজমায়েত করা যাবে না, গণসমাবেশ করা যাবে না, মসজিদে না গিয়ে বাসায় নামাজ পড়ার। অনেক জায়গায় কিন্তু বাস্তবায়ন ভালভাবে হয়েছে যেমন টোলারবাগ, বাসাবো এবং মাদারীপুর।" "এসব এলাকায় কিন্তু লকডাউনের ভাল ফল পাওয়া গেছে। মানুষ যদি সচেতন হয়ে কাজ করে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তাহলে এটে (সংক্রমণ) নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে।" এদিকে দেখা গেছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জে সংক্রমণ বেশি হয়েছে সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের মধ্যেই। যে কারণে সাধারণ ছুটি কতোটা কার্যকর সেটি নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন। যেহেতু একমাসের বেশি সময় ধরে সারাদেশের গণপরিবহন, অফিস আদালত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ তাই ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখে অর্থনীতি সচল করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে এসেছে।

লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে কার্যকর লকডাউনের সফলতা যেমন আছে তেমনি এর অর্থনৈতিক ক্ষতিও বহুমাত্রিক। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করা হয়েছিল এ মাসে বিশ্বব্যাংক এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে প্রবৃদ্ধি কমে ২-৩ শতাংশ হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে এই মহামারি যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলে এবং সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে চলে যায় তাহলে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হবে যা বাংলাদেশে -৫.২ পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদের আশংকা করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। "এটা আমাদের অগ্রগতির ক্ষেত্রে মারাত্মক অন্তরায়। সবচেয়ে বড় হচ্ছে যে লকডাউনের ক্ষতির এই মুহূর্তের যে হিসাব সেটার সাথে সাথে কিন্তু আমাদের আগামীর ক্ষতিটাকেও মনে রাখতে হবে।" "অর্থাৎ এ সময়ে যত বিনিয়োগ হতে পারতো, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চললে সেগুলো থেকে যে অর্জন হতে পারতো, সেগুলো কিন্তু হবে না। এবং এ কারণেই ক্ষতির পরিমাণের থেকেও আমি মনে করি যে এর ব্যাপ্তি এত ব্যাপক পরিসরের হবে যে, সেটাই চিন্তার ব্যাপার।" বাংলাদেশে সাধারণ ছুটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের হিসেবে সাধারণ ছুটির একমাসে দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১ লাখ ২ হাজার ৩শ কোটি টাকা। যা দৈনিক কমপক্ষে ৩৩০০ কোটি টাকা।

কৃষি মৎস ও প্রাণিসম্পদ খাতে অর্থনৈতিক অবরুদ্ধ অবস্থার কারণে প্রতিদিন ২শ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, শিল্প অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ১শ ৩১ কোটি টাকা। তবে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার সেবা খাতে, প্রতিদিনের ক্ষতি হচ্ছে ২০০০ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির নিজস্ব হিসেবে সারাদেশে ৫৬ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো ক্ষতির হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বিবিসিকে জানিয়েছেন তারা ক্ষতির হিসাব করছেন সেটি শিগগিরই জানানো হবে। "আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধির হিসাব করছি। সেটা আমি প্রধানমন্ত্রীর রুটিন অনুমোদনের পরে ছেড়ে দিব।" "আমরা মাঝামাঝি ৫/৬ শতাংশের মধ্যে থাকবো বলে আমার ব্যক্তিগত এবং আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন এই খাতে, আমাদের ধারণা।" "তবে এটাও বলা উচিৎ আরো দুমাস আমাদের হাতে আছে। মে, জুন যদি করোনা প্রলম্বিত না হয়, এই দুই মাসে আমরা ডাবল কাজ করে নানাভাবে ক্ষতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করবো।" "কারণ আমরা গত কয়েকবছর যেটা অর্জন করেছিলাম সেটা হারাতে চাই না, এটা আমাদের জন্য কষ্টের হবে।" করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির সার্বিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

বিভিন্ন খাতের জন্য বরাদ্দ এই অর্থ স্বল্প সুদে ঋণ হিসেবে দেয়া হবে। বিআইডিএস এর নাজনীন আহমেদ বলেন, "সহজ পন্থায় এই ঋণ দ্রুত বিতরণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে যেসকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেননা, তারা অন্তত সেই বেতনটা দিতে সক্ষম হবে।"

লকডাউন তুলে দিলে পরিস্থিতি কী হতে পারে?
তবে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ পর্যায়ে লকডাউন তুলে নেয়া ঠিক হবে না বলেও মনে করেন নাজনীন আহমেদ। "আমি মনে করি এই মুহূর্তে লকডাউন তুলে দেয়ার সময় আসেনি। তবে আমাদের সাপ্লাই চেইন ঠিক রেখে অনলাইন কেনাকাটার কিছুটা বিস্তৃত করে, কৃষির সাপ্লাই চেইন ঠিক রেখে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিক্রি এবং কাচামাল পাওয়ার জন্য যে সুযোগ তৈরি করা সেইটা যদি আমরা ঠিক রাখতে পারি তাহলে আমরা ক্ষতিটা কিছুটা সামাল দিতে পারবো।"

এদিকে পর্যায়ক্রমে লকডাউন কিছুটা শিথিল করার চেষ্টা থাকলেও সাধারণ ছুটির মেয়াদও বেড়েছে। আগামীতে পর্যায়ক্রমে সেটি শিথিল করার পরিকল্পনা থাকলেও সহসা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হচ্ছে না এটা স্পষ্ট। যে কারণে বলা হয়েছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে প্রয়োজনে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান সরকারের পরিকল্পনা একের পর এক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করা। "এই মুহূর্তে আপদকালীন পরিকল্পনা হলো করোনা থেকে মৃত্যুহার কমাতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আমরা পুনর্বাসনের কাজ শুরু করে দিয়েছি।"

"স্বাস্থ্য এবং কৃষি কিন্তু উচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এই দুই খাতে আমাদের আগামী অর্থবছরের বাজেটে বড় অংশ নেবে। প্রণোদনা, ঋণদান ইত্যাদি এবং সরাসরি যারা খুবই ভয়ংকরভাবে নিচে আছে, কোনো কিছু করতে পারছেন না, তাদের জন্য আমরা আমাদের যে নিরাপত্তা বলয় আছে তার আওতায় সহায়তা দিয়ে যাবে।"

"তবে হ্যাঁ, বিনয়ের সঙ্গে বলছি যে কিছু লোক কষ্ট পাবে। গত বছরের তুলনায় তারা এবার একটু বেশি কষ্ট পাবে। এইটা আমরা পার হতে পারবো আশা করি।" এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে এরই মধ্যে সীমিত আকারে কল কারখানা, রেস্তোরা খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

যদিও এসব সিদ্ধান্ত ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে আশঙ্কা বাড়াচ্ছে, কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে প্রয়োজনের তাগিদে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এখনো যে গতি দেখা যাচ্ছে সেটি কবে থামবে বা কমতে থাকবে সেটি স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না। বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মে মাসেও পরিস্থিতির উন্নতি নিয়ে সন্দিহান।