• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ২৪ আগস্ট, ২০২০ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

সাহেদের জালিয়াতির টাকা সিঙ্গাপুরে!

ক্রাইম প্রতিদিন ডেস্ক

করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা ও চিকিৎসার নামে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের শতকোটি টাকার জালিয়াতির তথ্য মিললেও দেশে তাঁর এই টাকার পুরো হদিস মিলছে না। র‌্যাবের পর দুদক ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাঁর আর্থিক জালিয়াতির অনুসন্ধান করছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সাহেদের নামসর্বস্ব ১৩ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গত পাঁচ বছরে ৯১ কোটি টাকা জমা হলেও এখন স্থিতি (জমা) আছে মাত্র দুই কোটি। তাঁর বিরুদ্ধে ৫৬টি মামলার এজাহারসহ বিভিন্ন নথিপত্রে ১২ কোটি টাকা সরাসরি আত্মসাৎ এবং শতকোটি টাকার জালিয়াতির তথ্য আছে র‌্যাবের কাছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে শরিফসহ কয়েকজন হুন্ডি কারবারির সঙ্গে সাহেদের ঘনিষ্ঠতা আছে। সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে তাঁর ছয় কোটি টাকা আছে বলেও তথ্য মিলেছে।

জাহিদ ও রজব নামে দুই সিঙ্গাপুর প্রবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং পলাতক থাকা অবস্থায় স্ত্রীকে ভারত হয়ে সিঙ্গাপুরে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়ায় সাহেদ অবৈধ টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করেছেন বলেই ধারণা তদন্তকারীদের। আর্থিক বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে সিআইডি তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রমাণ হাতে পেলে সেখানে পাচারের বিষয়টিও যুক্ত হবে বলে জানায় সূত্র।

এদিকে গ্রেপ্তারকৃত যুব মহিলা লীগ নেত্রী (বহিষ্কৃত) শামিমা নূর পাপিয়ার সঙ্গে সাহেদের ঘনিষ্ঠতার তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা মিলে প্রতারণা করেছেন কি না তা খতিয়ে দেখতে দুজনকে একসঙ্গে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইছেন র‌্যাবের তদন্তকারীরা। সম্প্রতি বিদেশে টাকা পাচারের তথ্য পেয়ে তদন্তপূর্বক মানি লন্ডারিং মামলা দায়েরের জন্য সিআইডিকে চিঠি দিয়েছে র‌্যাব। দুদকের মামলায় সাত দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল সাহেদকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। 

তদন্ত সূত্র জানায়, র‌্যাবের হটলাইনে ভুক্তভোগীরা সাহেদের বিরুদ্ধে ১৬০টি অভিযোগ করেছেন। এরই মধ্যে র‌্যাব ৫৬টি মামলার নথিপত্র পেয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগে দেখা যাচ্ছে, সাহেদ সরাসরি ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তবে চাকরির নামে প্রতারণা, চিকিৎসায় প্রতারণা, পাওনা টাকায় হয়রানি, ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার জালিয়াতির অভিযোগ। সাহেদের নামে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৯টি ব্যাংকে হিসাব রয়েছে। তাঁর স্ত্রীর নামেও একটি ব্যাংক হিসাব আছে। রিজেন্ট হাসপাতাল ছাড়াও নামসর্বস্ব ১৩টি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব খোলেন সাহেদ। এসব হিসাবে জুলাই পর্যন্ত জমা হয়েছে ৯১ কোটি টাকা। স্থিতি আছে মাত্র দুই কোটি। ২০০৪ সাল থেকে সাহেদের ব্যাংক লেনদেন শুরু হলেও বেশির ভাগ জমা হয়েছে ২০১৫ সাল-পরবর্তী সময়ে।

রিজেন্ট ডিসকভারি ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস লিমিটেডের নামে গত ২২ ফেব্রুয়ারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে (এমটিবি) হিসাব খোলা হয়। কোনো কার্যক্রম না থাকলেও গত ১ মার্চ থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা হয়েছে তিন কোটি ১১ লাখ টাকা।

সূত্র মতে, রিজেন্ট হাসপাতালের করোনা চিকিৎসার নামে অবৈধভাবে আদায় করা টাকা রিজেন্ট ডিসকভারি ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের হিসাবে জমা করা হয়েছিল। রিজেন্ট হাসপাতালের নামে এনআরবি ব্যাংকে ১২টি হিসাব আছে। নামসর্বস্ব মুনলাইট রিসোর্ট লিমিটেডের নামে ব্যাংক হিসাব আছে ব্র্যাক ব্যাংকে। আরএস শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং কম্পানির নামে হিসাব রয়েছে এমটিবিতে। আরএস ট্রেডিং এবং মাল্টিপোল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে হিসাব আছে ট্রাস্ট ব্যাংকে। রিজেন্ট আর্কিটেক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং অ্যালবার্ট গ্লোবাল লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব আছে প্রিমিয়ার ব্যাংকে। ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ এবং এআরবিআইএস মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট নামে হিসাব আছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে। ফোর স্টার ইন্টারন্যাশনালের হিসাব রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে। কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটির নামে হিসাব রয়েছে ইউসিবিএলে।

সন্দেহে সিঙ্গাপুর কানেকশন : সূত্র মতে, সাহেদের পাসপোর্ট থেকে সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড ও মালেশিয়ায় বেশি ভ্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাবের অভিযানের পর স্ত্রীকে মোবাইল ফোনে সাহেদ সিঙ্গাপুরে চলে যাওয়ার কথা বলেন। সিঙ্গাপুর সিটির ম্যারিনা বরিবার্ড এলাকায় ডিবিএস ব্যাংকে সাহেদের ছয় কোটি টাকার তথ্য পেয়ে খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সিঙ্গাপুরে টাকা রাখার ব্যাপারে সাহেদকে সহযোগিতা করেন জাহিদ ও রজব নামে দুই বন্ধু। এদিকে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের হুন্ডি কারবারি শরিফের সঙ্গে লেনদেন করেন সাহেদ। এ ছাড়া সিলেট ও চট্টগ্রামের অবৈধ হুন্ডিচক্রের সঙ্গে ছিলেন ঘনিষ্ঠ। সাহেদের ঘনিষ্ঠরা তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, সাহেদ দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী ছিলেন না।

অন্যদিকে মাদক, প্রতারণাসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত পাপিয়াকে রিমান্ডে পেলে সাহেদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ। তিনি বলেন, ‘পাপিয়ার সঙ্গে সাহেদের পরিচয় ছিল বলে জানা গেছে। পরবর্তী সময়ে তাঁদের একসঙ্গে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে যাচাই করা হবে—তাঁরা মিলিতভাবে কোনো অপরাধ করেছেন কি না।’ অর্থপাচারের ব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্য সিআইডিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান আশিক বিল্লাহ।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোস্তফা কামাল  গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সাহেদের বিরুদ্ধে আর্থিক জালিয়াতি ও অর্থপাচারের তথ্য পেয়ে আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে চিঠি পাঠিয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে একটু সময় লাগে। কাজ শেষ হলে মামলা দায়ের করা হবে।’

প্রসঙ্গত, গত ৬ জুলাই উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে র‌্যাবের অভিযানের পর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাহেদ করিমের ভয়াবহ জালিয়াতির তথ্য উঠে আসে। ১৫ জুলাই তাঁকে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে দুই মামলায় সাহেদকে ২০ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে র‌্যাব। উত্তরা-পূর্ব ও উত্তরা-পশ্চিম থানার চার মামলায় আদালতের আদেশে তাঁকে আরো ২৮ দিনের রিমান্ডে নেবে পুলিশ। এরই মধ্যে পদ্মা ব্যাংকের কোটি টাকা আত্মসাতে দুদকের মামলায় আদালত সাহেদকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন।