• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ৩ অক্টোবর, ২০২০ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

কে হচ্ছেন আল্লামা শফীর উত্তরসূরি!

ক্রাইম প্রতিদিন ডেস্ক

কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)-এর নেতৃত্ব নিয়ে চলছে অস্থিরতা। এ নিয়ে কওমি অঙ্গনে দু’টি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায়ই আজ বেফাকের মজলিসে আমেলার বৈঠক হতে যাচ্ছে। এ বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হবে কারা আসছে বেফাকের নেতৃত্বে। বেফাকের অধীনে ছয়টি স্তরে সারা দেশের ১৩ হাজার মাদ্রাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। কওমি শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি থাকায় এর গুরুত্ব বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে সরকারের সঙ্গে কওমি আলে? মদের যোগাযোগও বেড়েছে। 

বেড়েছে কর্তৃত্ব। এতোদিন হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ্‌ আহমদ শফীর হাতে বেফাকের নিয়ন্ত্রণ ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর বেফাকের মূল এই পদটিতে নতুন কাউকে বসানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কওমি সংশ্লিষ্টদের। বিশেষ করে বেফাকের সভাপতি পদাধিকার বলে বাংলাদেশের কওমি শিক্ষার সর্বোচ্চ সংস্থা আল-হাইআ’তুল উলয়ার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে থাকেন। জানা গেছে, আজ সারা দেশের প্রায় ১৫৭ সদস্য বিশিষ্ট আমেলা কমিটির বেশির ভাগ সদস্য উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষভাবে তাদের সমর্থন প্রকাশ করে সভাপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন। 

তবে আমেলার সদস্যদের নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। এ সবের মধ্যেই আমেলা বৈঠক সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা ও গঠনতন্ত্র অনুসারে আমেলা মিটিং পরিচালনা করাসহ বেশকিছু বিষয় নিয়ে বেফাকের খাস কমিটির একটি জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছিল গত ৩০শে সেপ্টেম্বর। মজলিসে খাসের বেশির ভাগ সদস্যের উপস্থিতিতে এ বৈঠকে বেশকিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

কাউন্সিল হচ্ছে না: সদ্য প্রয়াত হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমদ শফী। একইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের সভাপতি এবং কওমি সনদের স্বীকৃতির পর কওমি মাদ্রাসাগুলোর পৃথক ৬টি শিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত সর্বোচ্চ অথরিটি ‘আল-হাইআ’তুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যাহ্‌’-এর চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। হাইআ’তুল উলয়ার গঠনতন্ত্রে বলা আছে যিনি বেফাক বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন তিনি-ই এই সংস্থারও চেয়ারম্যান হবেন। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ এ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারি স্বীকৃতি আসায় এ সংস্থার চেয়ারম্যান এর আসনে কে বসেন এটা সব মহলে গুরুত্ব বহন করে। তবে বেফাকের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল হয় ৫ বছর পরপর। যেহেতু সর্বশেষ কাউন্সিল ২০১৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে তাই এখন আর কাউন্সিলের সম্ভাবনা নেই। ফলে আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত মজলিসে আমেলা (নির্বাহী কমিটি) দ্বারা নির্বাচিত ভারপ্রাপ্ত সভাপতির মাধ্যমে কাজ চালানো হবে, পরবর্তী কাউন্সিলে চূড়ান্ত সভাপতি নির্বাচন হবে।

বেফাক বোর্ডে একক আধিপত্য ও অস্থিরতা: বেফাক বোর্ডে একক আধিপত্য ও নানা অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে বেশ অস্থিরতা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে কওমি অঙ্গনে চলছে ব্যাপক তর্কবির্তক। যে অস্থিরতা এখন কেবল বেফাক নয় বরং দেশের ইসলামী অঙ্গন এবং কওমি মাদ্রাসাসহ ইসলামী রাজনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। এই অস্থিরতার শুরু অনেক আগে থেকেই। তবে শুরুটা বেফাক ও হাইআ’তুল উলয়ার মধ্যে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে। 

কিন্তু বিষয়গুলো সামনে এসেছে হাটহাজারী মাদ্রাসার বিশেষ একটি শূরা বৈঠকের পরে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বেফাকের আমেলা মজলিসের এক সদস্য। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ১৪ই জুলাই শূরা বৈঠকে হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পর থেকেই অস্থিরতা শুরু হয়। কওমি অঙ্গনে এই অস্থিরতা পরবর্তীতে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, আল্লামা শাহ্‌ আহমদ শফী ও শফিপুত্র আনাস মাদানীর একটি যৌথ ভিডিওর মাধ্যমে সুরাহা হয়। এর আগে বেফাকে অনিয়ম নিয়ে কয়েকটি অডিও প্রকাশিত হয়।

এসব ফোনালাপের ভিত্তিতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সহ ৩ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। যদিও সে তদন্ত রিপোর্ট এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে গত কয়েকদিন আগে বেফাকের সভাপতি আল্লামা শাহ্‌ আহমদ শফী মারা যান। ফলে বোর্ডটির ক্ষমতা চলে যায় যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সিনিয়র সহ-সভাপতি ও মাওলানা আব্দুল কুদ্দুসের হাতে। বর্তমানে কুদ্দস মহাসচিব ও সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে পুরো বোর্ডটি এখন তার নিয়ন্ত্রণে। 

এদিকে বড় একটি পক্ষ তার পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে এখনো। এসব প্রতিবাদের মুখে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে বেশ কয়েকবার ঘোষণা দিলেও তিনি তা করেননি। বেফাকের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা বলেন, বেফাকের সর্বোচ্চ কমিটি হলো- ‘মজলিসে খাস’ যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৫ জন। এদের মধ্যে মাওলানা আনাস মাদানী, মুফতি ফয়জুল্লাহ এবং মুফতি নূরুল আমীন ছাড়া বাকি সবাই মহাসচিব ও সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল কুদ্দুসের পদত্যাগের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। তিনিও সম্মতি দিয়েছেন, নির্বাহী কমিটির মিটিংয়ে পদত্যাগ করবেন। এরমধ্যে মাওলানা আনাস মাদানী সমপ্রতি ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার হওয়ায় অনেকটা আড়ালে চলে গেছেন। বোর্ডের শেষ দু’টি বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন না।

আরও পড়ুন:  তুই যদি মুখ খুলিস তবে মেরে ফেলব!

কে হবেন বেফাকের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি: আজ শনিবার আল্লামা শাহ্‌ আহমদ শফীর উত্তরসূরি নির্ধারণে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে বোর্ডটির নির্বাহী কমিটি। বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচন হবে। তারপর মহাসচিব ও সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে সেই পদেও নির্বাচন হবে। পদগুলোর বরাবরই নির্বাচন হয়ে আসছে সিলেকশন পদ্ধতিতে। তাই বৈঠকের সভাপতি বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে একজনের নাম ঘোষণা করবেন সেটা কণ্ঠভোটে পাস হলে তিনিই আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। 

কওমি সূত্রগুলো বলছে, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে ‘বোর্ডের সভাপতির তালিকায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছেন আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী। কিন্তু তিনি বোর্ডের সভাপতি চাইলেও হতে পারবেন না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। তার কারণ হিসেবে জানা গেছে, তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব। বেফাকের গঠনতন্ত্রে অনুযায়ী, রাজনীতিতে পদধারী কেউ প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হতে পারবেন না। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এইজন্য তিনি রাজনীতি ছাড়তেও প্রস্তুত রয়েছেন। 

অপরদিকে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে যাত্রাবাড়ীর আল্লামা মাহমুদুল হাসানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দেখতে চান বর্তমান মহাসচিব আব্দুল কুদ্দুস এবং চরমোনাই পীরের সমর্থকসহ একটি পক্ষ। সূত্রগুলো জানিয়েছে, আল্লামা কাসেমী সভাপতি পদে এলে মহাসচিব আব্দুল কুদ্দুসকে পদত্যাগ করতে হবে। ফলে তিনি নিজেও চাচ্ছেন না কাসেমী প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে আসুক। 

তবে মহাসচিব ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, যদি তিনি চাপের মুখে পড়েনও তাহলে শুধু মহাসচিব পদটি ছেড়ে দেবেন কিন্তু তার সিনিয়র সহ-সভাপতির পদটিতে থেকেই যাবেন। এখন আহমদ শফীর অনুসারীরা বেফাক ও হেফাজতের শীর্ষ পদে পছন্দের ব্যক্তিদের বসিয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই অংশ যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মুহতামিম মাহমুদুল হাসানকে বেফাকের শীর্ষ নেতৃত্বে বসাতে তৎপর বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। মাহমুদুল হাসান গুলশানের আজাদ মসজিদেরও খতিব। তিনি আগে বেফাকে সক্রিয় ছিলেন না। 

তিনি ২০১৭ সালে বেফাকে যোগ দেন। এ ছাড়াও হেফাজতের বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী ও তার মামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর নামও শোনা যাচ্ছে। জুনায়েদ বাবুনগরী এখন হাটহাজারী মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস ও শিক্ষাসচিব। মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ফটিকছড়ির আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলূম বাবুনগর মাদ্রাসার মুহতামিম। এদিকে কুদ্দুস মহাসচিব পদ থেকে পদত্যাগ করলে, এই পদের জন্য আলোচনায় আছে মামুনুল হক ও মুসলেহ উদ্দিনের নাম। মুসলেহ উদ্দিন সিলেটের গওহরপুর মাদ্রাসার মুহতামিম। তিনি বর্তমানে বেফাকের সহ-সভাপতি। সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকা দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মুহতামিম মাহমুদুল হাসান এই প্রতিবেদক’কে বলেন, আমার কোনো লবিং নেই। আমার বেফাকে তেমন একটা যাওয়াও পড়ে না। আমি আমার মাদ্রাসা ও বাসায় থাকি। সৃষ্টিকর্তা যা ফয়সালা করবেন, আমি সেটাতেই খুশি।