• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ২৬ অক্টোবর, ২০২০ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

এমপি ইলিয়াসের কথিত পিএস ভূমি দখলের নতুন সম্রাট!

আলমগীর হোসেন

নাম শুভ প্রভাত চক্রবর্তী বাবু। ১২ বছরে আগেও ছিলেন শ্যামলী পরিবহনের সুপারভাইজার। এরপর করেছেন ডিমের ব্যবসা, ছিলেন লজিং মাষ্টার। থাকতেন মেসে। ২০১৫ সালে তিনি যোগদান করেন   ঢাকা-১৬ আসনের এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার পিএস হিসেবে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বাবুকে। পিএস হয়েই পেয়ে গেছেন তিনি আলাদিনের চেরাগ। শূন্য থেকে এখন কোটিপতি বাবু। থাকেন আলিশান ফ্ল্যাটে। চলেন বিলাসবহুল গাড়ীতে। কোটি কোটি টাকা লগ্নি করেন বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানেও। পল্লবীর সেকশন-১২, ব্লক-ই ৪৭ নং ভবনের তৃতীয় তলায় রয়েছে তার বিশাল ঠিকাদারী অফিস। এমপির ছত্রছায়ার থেকে তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের সহ-দপ্তর সম্পাদক পদটি। এই পদেও তুষ্ট নন পিএস বাবু। বর্তমানে মহানগর উত্তরের কেন্দ্রীয় পদ বাগিয়ে নিতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। ঢাকা-১৬ আসনের বিভিন্ন নেতাকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মাধ্যমে এইসব তথ্য জানা গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে ফুলে ফেপে পিএস বাবু আজ কোটিপতি। জবরদখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতাকর্মী এমনকি বিমানবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারাও। তার জবরদখলের অভিযোগের ক্ষতিয়ান তুলে  ধরে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন সাবেক কমিশরার এবং পল্লবী ৬নং সেকশনের সি-ব্লকের মসজিদ-ই-বায়তুল ফালাহ্ জামে মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক। শুধু বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগের এই নেতাই নয়,  গণকণ্ঠ প্রতিবেদককে অভিযোগ জানিয়েছেন বিমান বাহিনীর ভুক্তভোগী কয়েকজন কর্মকর্তাও। 

সাবেক কমিশনার আব্দুল মালেক লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) রাজধানী পল্লবীর সেকশন-১২, ব্লক-ই কালশী এভি-১ এর ৯২/১ ও লেন ১ এর ৯২/২ নং পুর্ণবাসন প্রকল্পে তিনি ছাড়াও তার ৮ ভাই বোন ৫ কাঠা প্লট বরাদ্দ পান। ২০১৫ সালে ওই প্লটের একাংশ দখল করেন এমপি ইলিয়াস মোল্লার পিসএস সুপ্রভাত চক্রবর্তী বাবু। শুধু তিনি দখল ই করেননি ওই প্লটে জবরদখল করে নির্মাণ করেছেন একাধিক দোকান। এই সব দোকান থেকে অগ্রীম বাবদ হাতিয়েছেন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। প্রতিমাসে ভাড়া নিচ্ছেন৩০ হাজার টাকা। এই খাতে গত ৫ বছরে তিনি লুটে নিয়েছেন প্রায় ২ কোটি টাকা। এখন নিজ সম্পত্তিতে গেলেও হত্যার হুমকি দিচ্ছেন সাবেক কমিশনার আব্দুল মালেককে। এ বিষয়ে তিনি তিনি অভিযোগ জানিয়েছেন সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ দপ্তরেও। 
সরেজমিনে এই প্লটে নির্মিত ২টি দোকানের ভাড়াটিয়ারা  জানান, আমরা অগ্রীম ৫ লাখ টাকা  দিয়ে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছি। প্রতি মাসে ভাড়া পরিশোধ করছি । এই সম্পুর্ণ টাকা নেন এমপির পিএস বাবু। দোকানিরা আরো বলেন জমি নিয়ে ঝামেলা থাকলে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। যিনি আামাদের দোকান বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি আমাদের পাওনা টাকা ফেরৎ দিলেই আমরা অন্যত্র চলে যাব। 


অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু সাবেক এই কমিশনারই  নয়, পিএস বাবুর জবর দখলের হাত থেকে রেহাই পায়নি বিমান বাহিনীর সাবেক এবং বর্তমান ৮৮ জন কর্মকর্তারাও। নথি ঘেঁটে জানা গেছে, পল্লবী’র বাউনিয়াবাঁধ সেকশন-১১ সুইচগেট সংলগ্ন ৩৫ শতাংশ জমি বিক্রি করে আবারও তা জবরদখল করেছেন বাবু ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সিন্ডিকেটের সদস্য মোশারাত হাসান বেনুর গাড়ী চালক মো. বিল্লাল হোসেন রাজু ও কয়েকজনের ব্যক্তিগত সহকারীর নামে জালজালিয়াতির মাধ্যমে দলিল তৈরী করে জবরদখল করেছেন পুরো সম্পত্তিটি। এখন হত্যার হুমকিতে নিজেদের সম্পত্তিতে যেতে সাহস পাচ্ছেন না সরকারী ওই কর্মকর্তারা। এই বিষয়ে অভিযোগ দাখিল করেছেন ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে তারা দৈনিক গণকণ্ঠকে বলেন, আমরা ৮৮ জন ধারদেনা করে পল্লবীর সেকশন ১১ বাউনিয়াবাধ সুইচগেট সংলগ্ন (জাগৃক) এর ৩৫ শতাংশ একটি প্লট কিনি। পরবর্তীতে আমরা জমিতে কাজ করতে গেলে এমপির পিএস বাবু ও তার সহযোগীরা বাধা দেয়। তারা ভুয়া দলিল তৈরী করে মালিকানা দাবী করেন এবং আমাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করে ভুয়া কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছেন। জানতে পেরেছি, জমিটি বিক্রির পায়তারা করছেন পিএস বাবু।

 এখন আমরা আমাদের জায়গায় যেতে পারি না, গেলেই হত্যার হুমকি দিচ্ছে চক্রটি। সেকশন-১১ বাউনিয়াবাঁধ সুইচগেট সংলগ্ন ওই সম্পত্তির নিরাপত্তা কর্মী-আব্দুল কুদ্দুস জানান, মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতনে আমাকে নিরাপত্তারক্ষি হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন এমপি’র পিএস বাবু। জমি নিয়ে কোন ঝামেলা থাকলে তাদের বিষয়, আমরা শুধুমাত্র নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি। এ্ বিষয়ে আর কোন মন্তব্য করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন তিনি। 

জানা গেছে, সুপ্রভাত চক্রবর্তী বাবু এমপি পিএস এর নাম ভাঙ্গিয়ে কমিশন বাণিজ্যেই এখন তার মূল পেশা। তিনি কোটি কোটি টাকা লগ্নি করলেও থাকেন ধরাছোয়ার বাহিরে। ঠিকারদার প্রতিষ্ঠানকে কোটি কোটি টাকা দিলেও খাতা কলমে তার নাম খূঁজে পাওয়া দূষ্কর। চলতি বছরে ঢাকা-১৬ আসনের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে ১০টি স্কুল কলেজ বর্ধিত (নতুন) ভবন নির্মাণে কোটি কোটি টাকা প্রকল্প আসে। এই সব প্রকল্পে বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের হয়ে অদৃশ্যভাবে অংশ গ্রহণ করেন পিএস বাবু। এই সব প্রতিষ্ঠান এমপির পিএস বাবু মনোনিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে টাকা লগ্নি করে কাজ পাইয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকার কমিশন । 


জানা গেছে, প্রকল্পগুলো হলো-পল্লবীস্থ সেকশন-১২, ব্লক-ডি, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গার্লস স্কুলের ৬ তলার ভবন নির্মাণ (দ্বিতীয় তলা নির্মিত); সেকশন-৬ এর মিরপুর আদর্শ বিদ্যানিকেতন স্কুলের ৬ তলা বর্ধিত করণের কাজ (প্রক্রিয়াধীন); পল্লবীস্থ শহীদবাগ (কালাপানি) এলাকর সরকারী বঙ্গবন্ধু সরকারী কলেজ  তিন কোটি টাকা বাউন্ডারী নির্মাণ কাজ (সম্পন্ন);  দুয়ারীপাড়া হাউজিং বাউন্ডারী নির্মান কাজ (সম্পন্ন)। সরকারী বঙ্গবন্ধু সরকারী কলেজের ১০ তলা ভবন নির্মাণে ১৭ কোটি টাকার কাজটি বাগিয়ে নেওয়ার জন্য জোর তদবির করছেন বাবু। শুধু তাই নয়, এক সময় তিনি অতিকষ্টে জীবন-যাপন করলেও  এমপির পিএস হওয়ার পর পল্লবীস্থ বাউনিয়াবাঁধ এলাকায় শ্বাশুড়ীর টিনসেড বাড়ীকে গড়িয়ে দিয়েছেন তিনি ৫ তলা বিলাসবহুল ভবন।

অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা-১৬ আসনের এমপি ইলিয়াস মোল্লা ক্রাইম প্রতিদিনকে বলেন, আমার অধীনে পিএস হিসেবে কোন পদবীতে কাউকে নিয়োগ দেইনি  যদি কেউ আমার পরিচয়ে পিএস নাম ভাঙিয়ে কোন অপরাধের সাথে জড়িত থাকে সে দায়িত্ব আমি নিবো না ।
সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে সুপ্রভাত চক্রবর্তী বাবু ক্রাইম প্রতিদিনকে বলেন, এমপির পিএস হিসেবে যোগ দেয়ার আগেই আমি ঠিকাদারীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক সময় কষ্ট করলেও ঠিকাদারীর মাধ্যমে আমি সরকারের কাছ থেকে ৪৬ লাখ টাকা ঋণ করেছি। এই টাকা দিয়েই আমি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। এই টাকা দিয়েই আমি ব্যবসা করছি। এমপির পিএস হিসেবে আমি কখনো কারো কাছে পরিচয় দেই না। আমি কোন অন্যায় কাজের সাথে জড়িত নই। একটি মহল আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে বলেও দাবি করেন পিএস বাবু।