• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ২৩ এপ্রিল, ২০২১ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুর ‘আজানের ধ্বনি’

তোফায়েল আহমেদ রামীম

আল্লাহ তাআলা মনোনীত সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন ব্যবস্থার নাম ইসলাম। এ জীবন ব্যবস্থা মানুষকে সব সময় কল্যাণের দিকে আহ্বান করে। মসজিদের মিনার থেকে মুয়াজ্জিন প্রতিদিন পাঁচবার সুললিত কণ্ঠে কল্যাণের দিকে ধাবিত হওয়ার সে আহ্বানই জানায়। সুমধুর এ আহ্বানই হচ্ছে আজান। মহাকবি কায়কোবাদ কবিতায় ছন্দে তা তুলে ধরেছেন এভাবে-
‘কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি। মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী। কি মধুর আযানের ধ্বনি! আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে, কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধমনে কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।’

মনোমুগ্ধকর আজানের বাণী মানুষকে নিয়ে যায় সফলতার দিকে; মহান সত্তা আল্লাহর সাক্ষাৎ পেতে; ধনী-গরীব, সাদা-কালো, উচু-নিচু, কৃষক- শ্রমিক সবাইকে নিয়ে আসে এক কাতারে। সেখানে থাকে না কোনো ভেদাভেদ। সবাই কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে এক কাতারে শামিল হয়। মহান রবের কৃতজ্ঞতায় শির নিচু করে সেজদায় অবনত হয়।

মহান রবের একান্ত সান্নিধ্য পাওয়ার অনন্য মাধ্যম সেজদায় পায় জান্নাতের অতুলনীয় সুঘ্রাণ। প্রভুর সান্নিধ্যে আত্মহারা-পাগলপারা হয়ে পদচারণা করে শান্তির কুসুম কাননে।

মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের সুর এতই মধুর যে, মুমিন-মুসলমানের সঙ্গে সঙ্গে অমুসলিমদের হৃদয়কেও শীতল করে দেয়; স্পর্শ করে, আকৃষ্ট করে তোলে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে। আজানের সুর-শব্দ এতই মোহনীয় যে মনকে ছুঁয়ে যায়, এই মধুর কলতান একবার শুনলে বার বার শুনতে মন চায়।

পৃথিবীর সবখানে এই আজান প্রতিদিন ধ্বনিত হয়। তাতে কখনো বিতৃষ্ণা লাগে না। পুরোনাও মনে হয় না। তাইতো সঙ্গত কারণেই মুসলিম উম্মাহ আজান থেকেই পায় শান্তি, সম্প্রীতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র।

আজান শব্দটি আররি, এর অর্থ হলো- ঘোষণা দেওয়া, জানিয়ে দেওয়া, আহ্বান করা, ডাকা ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তে নির্ধারিত কতকগুলো বাক্যের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে নামাজের জন্য মানুষকে আহ্বান করার নামই হলো আজান। আজান ইসলামের অন্যতম নিদর্শন বা প্রতীক। আজানের মাধ্যমে প্রতিটি মুমিনের অন্তর এক ঈমানী শক্তিতে উজ্জ্বীবিত হয়।

আজান প্রবর্তনের ইতিহাস
ইসলামে প্রচলিত আজান শুরুতে এমন ছিল না। আজান প্রবর্তনে রয়েছে সুন্দর ইতিহাস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জন্মভূমি মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় যান এবং মসজিদে নববির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তখন জামাআতে নামাজ পড়ার বিষয়টি যেমন উপলব্দি করেন। তেমনি মানুষকে মসজিদে একত্রিত করার উপায়ও চিন্তা করছিলেন।

প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজানের ধরন কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে মজলিস শুরু বা পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। তাতে প্রাথমিকভবে ঝাণ্ডা উড়ানো, আগুন লাগানো, শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া এবং ঢোল বাজানোর মতো ৪টি প্রস্তাব উঠে আসে। এর কোনোটিই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পছন্দ হয়নি।

কারণ কর্ম ব্যস্ততায় মানুষ ঝাণ্ডা উড়ালে তা দেখতে পাবে না। আগুন জ্বালানো অগ্নি উপাসকদের কাজ। শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া খ্রিস্টানদের কাজ আর ঢোল বাজানো ইয়াহুদিদের কাজ। সে কারণে সিদ্ধান্ত ছাড়াই মজলিসে শুরার অধিবেশন শেষ হয়।

চমৎকার স্বপ্ন ও সমাধান
ওই দিন দিবাগত রাতে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু চমৎকার স্বপ্ন দেখেন। ঘটনাটি ছিল এমন-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, এক ব্যক্তি শিঙ্গা নিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, শিঙ্গা বিক্রি করবে কি না, ওই ব্যক্তি প্রশ্ন করল- আপনি শিঙ্গা দিয়ে কি করবেন? উত্তরে হজরত জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি শিঙ্গা বাজিয়ে মানুষকে নামাজের দিকে আহ্বান করব। সে বলল, আমি কি এর চেয়ে ভালো জিনিসের কথা বলে দেব না? এ কথা বলে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আজানের শব্দগুলো শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বপ্নের বিবরণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমীপে পেশ করলে তিনি বললেন, নিশ্চয়ই এটি একটি সত্য স্বপ্ন। অতএব তুমি বেলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে আজানের বাক্যগুলো শিখিয়ে দাও। অতঃপর হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর কণ্ঠে জোহরের আজান ধ্বনিত হল। আজানের এ শব্দগুলো শুনে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দৌড়ে এসে বললেন-
‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে যিনি সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন তার কসম করে বলছি, তাকে যা দেখানো হয়েছে আমিও অনুরূপ দেখছি। আর এভাবেই আজানের প্রবর্তন হলো।’ (আবু দাউদ)

এ আজানই হচ্ছে মুমিন মুসলমানের জন্য দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণ ও সফলতার মূলমন্ত্র। অথচ অবিশ্বাসীরা আজানকে হাসি-তামাশা মনে করে। যা ওঠে এসেছে কুরআনুল কারিমের বর্ণনায়-
وَإِذَا نَادَيْتُمْ إِلَى الصَّلاَةِ اتَّخَذُوهَا هُزُوًا وَلَعِبًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لاَّ يَعْقِلُونَ
আর যখন তোমরা নামাজের জন্য আহ্বান কর (আজাব দাও), তখন তারা একে উপহাস ও খেলা বলে মনে করে। কারণ, তারা নিবোর্ধ।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৫৮)

মনে রাখা জরুরি
মুমিন মুসলমানের জন্য আজানের গুরুত্ব যেমন বেশি। আবার মুয়াজ্জিনের শান ও মান ঘোষণা করেছেন প্রিয় নবি। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা প্রমাণিত। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনে
- ‘যখন নামাজের সময় হয়, আর তোমরা দুই জন থাক, তাহলে তোমাদের থেকে একজন আজান ও ইকামত দেবে আর দুই জনের মধ্যে যে বড় সে ইমামতি করবে।’ (বুখারি)
- ‘যখন আজান দেওয়া হয়, তখন শয়তান বায়ূ নির্গমন করতে করতে এত দূরে চলে যায় যে, সেখান থেকে আজান শোনা যায় না।’ (বুখারি)
- ‘কেয়ামতের দিন মুয়াজ্জিনরাই হবে মানুষদের মধ্য থেকে সবচেয়ে লম্বা ঘাড়ের অধিকারী, অর্থাৎ বহু সওয়াব প্রাপ্ত হবে।’ (মুসলিম)

সুতরাং সুমধুর আজানের ধ্বনিতেই মসজিদের দিকে ধাবিত হবে মুমিন। তৈরি করে নেবে দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণ ও চূড়ান্ত সফলতা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুমধুর আজানে সাড়া দিয়ে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণ ও সফলতা সিঁড়ি বিনির্মাণের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামি শিক্ষা বিভাগ, ঢাকা কলেজ।