• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ২৯ এপ্রিল, ২০২১ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

এ যেন দিনে দুপুরে পুকুর চুরি!

ক্রাইম প্রতিদিন ডেস্ক

সংকেত দেখানোর জন্য সড়কে ট্রাফিক পুলিশ ব্যাটারিচালিত যে লাঠি ব্যবহার করে, দেশের বাজারে তার প্রতিটির দাম ১৫০ টাকা। সেই লাঠিই কেনা হয়েছে ৭ হাজার টাকায়। গাড়ির তলদেশের নিরাপত্তা পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হাতলওয়ালা আয়নার বাজারে দাম ৫০০ টাকা, কেনা হয়েছে ৫০ হাজার ৪০০ টাকায়। প্রতি কয়েল (৯০ মিটার) ক্যাট-৬ মানের তার দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকায়, কেনা হয়েছে ৬৭ হাজার ৭০০ টাকায়। ৫,০০০ টাকার একটি হার্ডডিস্কের দাম দেখানো হয়েছে ৮৩ হাজার টাকা। অস্বাভাবিক দরে এমন আরও অনেক পণ্য কিনেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের রাজধানীর তেজগাঁও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগ। গত অর্থবছরে সরকারি এই সংস্থাটির এক কোটি টাকার এমন অস্বাভাবিক কেনাকাটার খোঁজ মিলেছে। দাপ্তরিক কাজের এ ধরনের কেনাকাটায় গত অর্থবছরে সওজের বরাদ্দ ছিল ৯ কোটি টাকা। সব কেনাকাটার খোঁজ নিলে এরকম পুকুর চুরির ঘটনা আরও মিলবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাজধানীর তেজগাঁও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগ গত বছরের মে মাসে দরপত্রের মাধ্যমে এক কোটি টাকার  বিভিন্ন পণ্য কেনার জন্য চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়। প্রতিষ্ঠান চারটি হলোÑশহীদ অ্যান্ড ব্রাদার্স, জননী ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আশা এন্টারপ্রাইজ ও ইকন ইঞ্জিনিয়ারিং। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের তেজগাঁও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগের প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইদুল ইসলাম।

বাজার দামের চেয়ে বহু গুণ বেশি মূল্যে কেনাকাটা করার কারণ জানতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের তেজগাঁও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগের প্রকৌশলী মো. শামীমুল হকের মোবাইল ফোনে দু’দিন ধরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই সঙ্গে এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় ও কল করার কারণ জানিয়ে তার মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা (মেসেজ) পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি।

বেসামাল দাম!
অনলাইনে পণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠান দারাজের পণ্যের মূল্যতালিকা ঘেঁটে দেখার পাশাপাশি রাজধানীর ইলেকট্রনিকস ও ইলেকট্রিক পণ্যের মার্কেট মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের রায়ানস কম্পিউটারের শোরুম ঘুরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের তেজগাঁও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগের কেনা পণ্যের দামের সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি পণ্যও বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দামে কেনা হয়নি। প্রত্যেকটি পণ্যই কেনা হয়েছে বাজারের চলতি মূল্যের চেয়ে বহু গুণ বেশি দামে।

দেশের বাজারে ৮ ও ১৬ চ্যানেলের নেটওয়ার্ক ভিডিও রেকর্ডার (এনভিআর) প্রতিটির দাম ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকা, কেনা হয়েছে প্রতিটি ৮২ হাজার টাকায়। একইভাবে তথ্য সংরক্ষণের জন্য ২ টেরাবাইট ক্ষমতাসম্পন্ন মোবাইল হার্ডডিস্ক এক বছরের বিক্রয়োত্তর সেবাসহ দাম ৫ হাজার টাকা। কিন্তু এই হার্ডডিস্কই প্রতিটি কেনা হয়েছে ৮৩ হাজার টাকায়। প্রতি কয়েল (৯০ মিটার) ক্যাট-৬ মানের তার কেনা হয়েছে ৬৯ হাজার ৭০০ টাকায়। অথচ একই মানের তার বাজারে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চার হাজার টাকায় কেনা হয়েছে একটি নিরাপত্তা হেলমেট। অথচ বাজারে এ ধরনের হেলমেট ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। চার পোর্টের সুইচ কেনা হয়েছে প্রতিটি ৬২ হাজার টাকায়। বাজারে এ ধরনের পোর্ট বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ৪ হাজার টাকায়। আবার প্রতিটি ২৭ ইঞ্চি এলইডি মনিটর কেনা হয়েছে ৭২ হাজার টাকায়। অথচ দেশের বাজারে এ ধরনের মনিটর ২০ থেকে ২৭ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। দুই চাকার প্রতিটি ট্রলি দেশের বাজারে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এই ট্রলিই প্রতিটি কেনা হয়েছে ২৭ হাজার ৯৯ টাকায়।

পাঁচ কেজি ওজনের একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের তেজগাঁও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগ এই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রই প্রতিটি কিনেছে ২৪ হাজার ১০০ টাকায়। আর তিন কেজি ওজনের একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকায়। সওজের তেজগাঁও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগ তা কিনেছে ২০ হাজার টাকায়। অগ্নিনির্বাপণের জন্য যে পাউডার ব্যবহার হয় তার প্রতি কেজির বাজার মূল্য ১ হাজার টাকা। অথচ কেনা হয়েছে ৮ হাজার ৫০০ টাকায়। উঁচু ভবনে কাজ করার জন্য কর্মীর নিরাপত্তায় ব্যবহার করা হয় ডাবল হুক। এটির প্রতিটি কেনা হয়েছে ২৮ হাজার টাকায়। যদিও দেশের বাজারে এই ডাবল হুক প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ টাকায়।

আস্বাভাবিক দরে কেনাকাটার বিষয়ে সওজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনো বক্তব্য না মিললেও এটা নিশ্চিতভাবেই বড় ধরনের দুর্নীতি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার টেলিফোনে  বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে দুর্নীতি সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে গেছে। স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নেই। যার ফলে কেনাকাটায় এমন দেখা যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুর্নীতি ভয়াবহ ব্যাধি। যখন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, এতে অন্যদের দুর্নীতি করতে উৎসাহ জোগায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারলে একসময়ে গোটা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।’