• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ১২ জুন, ২০২১ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

খালেদা জিয়ার ফুসফুস, হার্ট, লিভার ও কিডনি আক্রান্ত

ক্রাইম প্রতিদিন ডেস্ক

করোনা-পরবর্তী জটিলতায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম  খালেদা জিয়ার ফুসফুস, হার্ট, লিভার ও কিডনি—শরীরের এই চারটি অঙ্গই আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে লিভার ও কিডনি প্রায় অর্ধেক কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। তিনি স্বাভাবিক কার্যক্রম যথাযথভাবে করতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা প্রয়োজনে তার লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের (প্রতিস্থাপন) সুপারিশ করেছেন। এ ছাড়া তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন, হৃদরোগের কারণে খালেদা জিয়ার শরীরের যেকোনো একটি চেম্বার বা অংশের মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিত ১০ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড সম্প্রতি এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বেশ কয়েক দফা সুপারিশ করেছে। এতে খালেদা জিয়ার বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থা পর্যালোচনার পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোরও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে এবং তার (খালেদা জিয়ার) ভবিষ্যৎ চিকিৎসা পরিচালনার জন্য বোর্ড সুপারিশ করেছে যে রোগীকে এমন একটি উচ্চতর কেন্দ্রে স্থানান্তর করা উচিত, যেখানে মাল্টিসিস্টেম ডিজিজ ম্যানেজমেন্টের জন্য অগ্রিম সুবিধা পাওয়া যায়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থার কারণে তার বিশেষায়িত চিকিৎসা দরকার। 
 
তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের মতো জটিল রোগীদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা বিদেশেই রয়েছে। ফলে তাকে বিদেশে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।

গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, সরকার যথেষ্ট করেছে। এনাফ ইজ এনাফ। এবার জামিন দিয়ে তাকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মতো একজন ভিভিআইপি রোগীর পরীক্ষা বা অপারেশনের প্রয়োজন হলে ডাক্তাররা সহজে ঝুঁকি নিতে চাইবেন না, এটিই স্বাভাবিক। ফলে বিদেশে চিকিৎসা তাঁর নিজের এমনকি সরকারের জন্যও সুবিধাজনক। কারণ এখানে তাঁর কিছু হয়ে গেলে সরকার দায় এড়াতে পারবে না।

চিকিৎসকদলের এক সদস্য গণমাধ্যমকে জানান, খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে কবে বাসায় ফিরবেন, সেটি মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শের ওপর নির্ভর করছে। কারণ এখনো তিনি করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন। 
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান শারীরিক অবস্থায় ম্যাডামের সুচিকিৎসা করতে হলে তাকে দেশের বাইরে সর্বাধুনিক সুবিধা সংবলিত চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া দরকার। পরবর্তী ফলোআপ চিকিৎসাও তার বিদেশেই হওয়া উচিত।’       
 
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর ২৮ এপ্রিল থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় ৩ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত সিসিইউয়ে (ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট) থাকার পর এখন তাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। তবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে কবে তিনি বাসায় যেতে পারবেন, সে বিষয়ে চিকিৎসকরা এখনই কিছু বলতে পারছেন না। কারণ এখনো তিনি করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক চিকিৎসক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার খাদ্যনালিও সংক্রমিত হয়েছে। সিসিইউয়ে থাকার সময় ১৪ দিনে ফুসফুস থেকে প্রচুর ফ্লুইড বের করে তার শ্বাসকষ্ট লাঘব করে প্রায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তার রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে সে জন্য প্রচুর ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া তাঁকে চার ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে।

বস্তুত কারাগারে এবং করোনায় বাসায় আটকে থাকার কারণে গত চার বছরে নিয়মিত চেকআপ না হওয়ার কারণে খালেদা জিয়ার লিভার ও কিডনি আগে থেকেই দুর্বল অবস্থায় ছিল, যা করোনা-পরবর্তী জটিলতায় প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে চিকিৎসকরা মনে করেন। মেডিক্যাল বোর্ড তাদের পর্যালোচনায় জানায়, করোনা-পরবর্তী জটিলতার উপসর্গ হিসেবে তার খাদ্যনালির বিভিন্ন জায়গায় মাইক্রোহেমারিজ (ওবিটি) হয়েছে। এ জন্য স্টুলের সঙ্গে রক্ত গেলেও সেটি দেখা যায় না। ফলে তার শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।

এ ছাড়া লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে শরীরে আয়রন, প্রোটিন ও হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়ায় খালেদা জিয়া আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছেন বলেও মনে করেন তারা। এ জন্য চার ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পাশাপাশি তার মুখে খাওয়া এবং অ্যালুমিনিয়াম ইনজেকশনের মাধ্যমে তাকে প্রোটিনও দেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসকরা বলেছেন, খালেদা জিয়ার শরীর হিমোগ্লোবিন ও আয়রন তৈরি করতে পারছে না। তার অদৃশ্য রক্তক্ষরণ (ডিআই ব্লিডিং) হচ্ছে। এখন এটির কারণ বা উৎস খুঁজে পেতে হলে তার এন্ডোসকপি করতে হবে। আর এন্ডোসকপি করতে হলে খালেদা জিয়াকে অজ্ঞান করতে হবে। কিন্তু এটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন রোগীকে বাংলাদেশের একজন চিকিৎসকের পক্ষে করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের মতে, ৭৫ বছরের সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো বেশ কঠিন। তাছাড়া  চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধরনের পরীক্ষার জন্য অনেক সময় অন দ্য স্পট সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ জন্য অত্যাধুনিক ও উন্নত কোনো কেন্দ্র নেই।
 
ডা. এফ এম সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড খালেদা জিয়ার শারীরিক সমস্যা চিহ্নিত করে ৫ দফা পরামর্শ বা সুপারিশ করেছে। 

পাঁচ দফা সুপারিশে যা বলা হয়েছে

১. ক্রনিক লিভার ডিজিজ (লিভার সিরোসিস) কোন পর্যায়ে রয়েছে তা পরীক্ষা করে খাদ্যনালির কোন জায়গা থেকে (ডিআই ব্লিডিং) হচ্ছে, সেটি বের করতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনও লাগতে পারে। 

২. কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে খালেদা জিয়ার শরীর প্রোটিন ধরে রাখতে পারছে না। প্রস্রাবের সঙ্গে অনেক প্রোটিন বের হয়ে যায়। এ জন্য তার আধুনিক বা উচ্চতর চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ ক্রনিক লিভার ডিজিজ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে।

৩. হৃদরোগের জটিলতার কারণে যেকোনো সময় তার হৃদরোগের বেদনায় বিশেষ একটি চেম্বার বা অংশে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তার হার্টের স্পন্দন মাঝেমধ্যেই অনিয়মিত (ইরেগুলার হার্টবিট) হয়ে পড়ে এবং এটি যেকোনো সময় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

চিকিৎসকদলের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, হার্টের জটিলতার সূত্র ধরে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা, এমনকি তাৎক্ষণিকভাবে তাকে রিং পরানোর প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের চিকিৎসকদের অনেকেই সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। 

৪. রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণে খালেদা জিয়ার বিভিন্ন জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার কারণে অন্যের সাহায্য ছাড়া তিনি দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেন না। এটা ক্রনিক লিভার ডিজিজ ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজের কারণে। এই রোগের চিকিৎসা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলেছেন, এটির চিকিৎসা বিশ্বের অত্যন্ত উন্নত ও আধুনিকতম হাসপাতালেই সম্ভব।

সবশেষে খালেদা জিয়ার পারিবারিক রোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করে চিকিৎসকরা তার রোগের যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি বলে মনে করেন।

উল্লেখ্য, খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ এস্কান্দার ক্যান্সারে এবং বোন খুরশিদ জাহান হক ক্রনিক লিভার ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।