• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ১৩ জুলাই, ২০২১ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

যত প্রেম তত শরীর!

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী

শেষ কবে ভালবাসার মানুষটিকে কমপ্লিমেন্ট দিয়েছেন? না, চুপিচুপি ফোনে বা হোয়াট্সঅ্যাপে নয়! পাঁচ জনের সামনে। একেবারে গোটা দুনিয়াকে সাক্ষী রেখে!

ঠোঁটে ঠোট-হাতে হাতঃ ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে নিজের ভালবাসার মানুষকে কমপ্লিমেন্ট দিয়ে প্রেমের ঘোষণা করছেন সেলিব্রিটিরা। চোখে চোখ, হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট মেলাবার জন্য যারা লোক-লজ্জার তোয়াক্কা করে না,তাদের বলা হয় পিডিএ (পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন)যুগল।. আর তারই আপডেটেড সংস্করণ ভিডিএ (ভার্চুয়াল ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন)। পার্টনারের সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি। সঙ্গে প্রেমে গদগদ দু-চার লাইন, আপনার প্রিয়তম বা প্রিয়তমার উদ্দেশে। এ ভাবেই নতুন প্রজন্ম বলছে,‘ম্যায়নে প্যার কিয়া!’

বিয়ের পরের টাটকা প্রেমঃ সম্প্রতি বলিউড অভিনেত্রী আসিন গাঁটছড়া বাঁধলেন মাইক্রোম্যাক্সের প্রতিষ্ঠাতা রাহুল শর্মার সঙ্গে। তাঁদের রিসেপশনের একটি অন্তরঙ্গ ছবি টুইটারে পোস্ট করে রাহুল লিখেছেন, ‘‘আমার বাহুবেষ্টনীতে আমার পৃথিবী।’’ নতুন ঘরণীর প্রতি রাহুলের ভালবাসার এই অভিব্যক্তি দেখে অনেক সিঙ্গল মেয়ে হয়তো হা-হুতাশ করেছেন, কমিটেড মেয়েরা কিছুটা হলেও ঈর্ষাণ্বিত হয়েছেন, আর যারা কোনও স্টেটাসের ধার ধারেন না, সন্দেহের চোখে হয়তো বলেছেন, ‘‘প্রথম প্রথম তো, কিছু দিন যাক না!’’.কিছু দিনের কথা তোলা থাক।. বিয়ের পরে পরেই যদি আপনার স্বামী বিশ্বের দরবারে এ ভাবেই আপনাকে অভিবাদন করেন, এর চেয়ে বেশি কি চাইবেন?

হিন্দিতে বলে, ‘প্যার কভি কভি দিখানা ভি পরতা হ্যায়!’ দেখনদারির নেশায় তো বুঁদ আজকের প্রজন্ম। সোশ্যাল মিডিয়ায় আটকে গিয়েছে জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, মুহূর্ত, অনুভুতি। সেই ইন্দ্রজাল ভেদ করার সাধ্য কি আছে ভালবাসা ও তার বহিঃপ্রকাশের?

পত্নী মীরা রাজপুতের জন্মদিনে বলিউড হার্টথ্রব শাহিদ কপূর তাঁদের বিয়ের একটি রোমান্টিক ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘‘হ্যাপি বার্থদে মাই বেবি ওয়াইফ!’’

হায় বিরুষ্কাঃ কোনও উপলক্ষ্যের প্রতীক্ষায় নয়। আজকের প্রজন্ম বোধ হয় সবচয়ে বেশি খুশি হয়, যদি তার প্রফেশনাল কৃতিত্বের স্বীকৃতি দেয় তার মনের মানুষ। সর্বসমক্ষে। যেমন করেছিলেন বিরাট কোহলি। এখন যতই বিরুষ্কা নিয়ে গোল বাধুক, প্রেমিকা অনুষ্কা শর্মা অভিনীত ‘এনএইটচ টেন’ দেখার পরে তাঁর টুইট, ‘‘কী অসামান্য অভিনয় আমার প্রিয়তমার! খুবই গর্বিত ওঁর জন্য।’’ কিছুটা একই প্রতিক্রিয়া টুইটে জানিয়েছিলেন দীপিকা পাড়ুকোন তাঁর বয়ফ্রেন্ড রণবীর সিংহের ‘দিল ধাড়াক নে দো’ ছবিটি দেখার পরে।

বেশ করেছি প্রেম করেছিঃ জেন ওয়াই প্রজন্মের যারা এই ট্রেন্ডের সঙ্গে অভ্যস্ত, তাদের প্রত্যেকেরই প্রথম ও শেষ জবাব ‘‘ভাল লাগে, তাই করি।’’ কেন করি তার কারণ তলিয়ে দেখার অবসর নেই। তবে যুক্তি নানা জনের নানা রকম। যেমন, ফেসবুকে ঘন ঘন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে নিজস্বী পোস্ট করেন স্কুলশিক্ষিকা শিঞ্জিনী রায়। তাঁর মতে, ‘‘ফেসবুক খুব ব্যক্তিগত স্পেস আমার কাছে। বন্ধু ও পরিবারের জন্য করি।’’ তেমনই যুক্তি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত পিয়া ভ়ট্টাচার্যের।
‘‘আত্মীয়- পরিজন বাইরে থাকেন। তাঁরা চান আমি আর আমার স্বামীর একসঙ্গে ছবি দেখতে। তাই দিই।’’ জার্মানিতে গবেষণারত তন্ময়িতা নায়েক. বলেন, ‘‘বয়ফ্রেন্ড কমপ্লিমেন্ট দিয়ে কিছু পোস্ট করলে ভালই লাগে।. তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কখনই শেয়ার করব না।’’ ‘‘ভিডিএ হোক বা পিডিএ, ভাব প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততাই শেষ কথা’’, বললেন বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত অঙ্কুর ঘোষ।

প্রেমহীনতায় বাঁচিতে চাইঃ তবে ভিডিএ-র পিছনে কাজ করে কিছু অদ্ভুত মানসিকতা। যেমন ধরুন, আপনার বন্ধু তাঁর প্রেমিকার জন্য গাল-ভরা কিছু পোস্ট করেছেন। তাই দেখে আপনার বান্ধবীরও একই বায়না। উপেক্ষা তো করা যায় না! অর্থাত্ জীবনের আর পাঁচটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতন ‘পিয়ার প্রেশার’ এখানেও।.আবার ভালবাসা প্রকাশের এই ধুম-জ্বর দেখে হীণমন্যতায় ভোগেন অনেক সিঙ্গল বা সদ্য ব্রেক আপ হওয়া তরুণ-তরুণী।. তাঁদের উদ্দেশে মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সাফল্য বা ব্যর্থতার মাপকাঠি হিসেবে ভালবাসাকে দেখা ঠিক নয়।. ভালবাসা জীবনের একটি অঙ্গ. মাত্র।’’ সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়েরও একই মত। ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ আসলে আমাদের ব্যক্তি সত্তার প্রকাশ মাত্র।. আমি আছি, আমার ভালবাসা আছে।’’ কিন্তু তা বলে না থাকাটা কোনও ব্যর্থতা নয়।

অন্যদিকে ভালবাসার অতিরিক্ত প্রদর্শন বা মাত্রাতিরিক্ত ভিডিএ কিন্তু ভালবাসার গভীরতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। সবটুকুই কি দর্শকের মুখাপেক্ষী না ভালবাসায় পরিপূর্ণতার এক স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক প্রকাশ-সেটাও ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।

খুল্লম খুল্লা প্যার করেঙ্গেঃ জেন ওয়াই প্রজন্মের প্রেমের রঙ বড় বিচিত্র! প্রেম হয় যত তাড়াতাড়ি, রিলেশনশিপ স্টেটাস বদল হয় তার চেয়েও দুরন্ত গতিতে। কিন্তু যব প্যার কিয়া তো ডরনা ক্যা! প্রেম যখন করেছি তখন খুল্লাম খুল্লাই করব, এমনটাই মত বেশিরভাগের।

তবে প্রেমের রঙ বদলালেও, বদলায়নি জেন ওয়াই প্রেমিকের দাবি। শুধু মনের মানুষের মণিকোঠায় নয়, নাম যেন লেখা থাকে দুনিয়ার দরবারে। আর সোশ্যাল মিডিয়া তো বিশ্বায়িত দর্শকের নামান্তরই বটে! শেক্সপীয়রের নাটকে নায়ক অর্ল্যান্ডো গাছের গুঁড়িতে লিখেছিলেন প্রেমিকা রোসালিন্ডের নাম।. সামনে ভ্যালেন্টাইন্স ডে! চমকে দিন আপনার প্রেমিকাকে।

এখনো ভাবছেন কী লিখবেন?

ইসকে আগে হাম/ অর ক্যা কহে/ জানাম সামঝা করো!