• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ১৬ জুলাই, ২০২১ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

বাস-লঞ্চে পুরনো চিত্র, মার্কেটে উপচে পড়া ভিড়

ক্রাইম প্রতিদিন ডেস্ক

করোনার উচ্চ সংক্রমণের মধ্যেই তুলে দেয়া হয়েছে সরকারি বিধিনিষেধ। চালু হয়েছে গণপরিবহন। খুলেছে বিপণি বিতান। ভিড় বেড়েছে সড়কে-মার্কেটে। রাজধানীর রাস্তায় দীর্ঘ যানজট। কয়েক কিলোমিটার যানজট দেখা গেছে মহাসড়কে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে সব খুলে দেওয়া হলেও বাসে-লঞ্চে সেই আগের চিত্রই ফিরে এসেছে। মার্কেটে মানুষের ভিড় দেখে মনে হচ্ছে না দেশে করোনার অতি উচ্চ সংক্রমণ বিরাজ করছে।

গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর মালিবাগ, মৌচাক, পল্টন, বাংলামোটর, কাওরান বাজার, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়কে বেড়েছে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ। সিগন্যালগুলোতে দেখা গেছে যানজট। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে এক আসন ফাঁকা রেখে গণপরিবহন চলাচলের কথা থাকলেও সেসব মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ বাসই যাত্রী পূর্ণ করে ছাড়তে দেখা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই যাত্রীরা উঠানামা করছেন বাসগুলোতে। যাত্রীদের মাস্ক থাকলেও অধিকাংশ বাসের চালক ও সহকারীর মুখে ছিল না কোনো মাস্ক। বাসে ছিটানো হচ্ছে না কোনো প্রকার জীবাণুনাশক দ্রব্য। ব্যবহার নেই হ্যান্ডস্যানিটাইজারেরও। নির্ধারিত ৬০ শতাংশের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করার অভিযোগ তুলেছেন অধিকাংশ বাসের যাত্রীরা। 
 
বুধবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ বিধিনিষেধ শিথিলের এ সময়ে গণপরিবহন চলাচলের কিছু শর্ত বেঁধে দিয়ে জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। যার কিছুই মানছেন না গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে গণপরিবহনে যাত্রী ওঠানামা করতে বলা হলেও কোথাও এমনটি দেখা যায়নি। নির্দিষ্ট গন্তব্যের বাস স্টেশনে আসার সঙ্গে সঙ্গে যে যেভাবে পারছেন ঠেলাঠেলি করে উঠছেন। এতে অনেককেই ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়তে দেখা গেছে। 

স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি বিআরটিসি’র বাসেও। বাসে যাত্রী উঠালেও কোনো হ্যান্ডস্যানিটাইজারের ব্যবহার নেই। মাস্ক ছাড়াই যাত্রী উঠছে। গতকাল দুপুরে কাওরান বাজার এলাকায় বিআরটিসি’র ঢাকা মেট্রো-ব ১৫৬৩৫২, ঢাকা মেট্রো-ব-১৫৫৮৭৬, ঢাকা মেট্রো-ব ১১৬০৫২, ঢাকা মেট্রো-ব ১৫৬২১৯, ঢাকা মেট্রো-ব ১৫৫৭০৯, বিহঙ্গ পরিবহন, আয়াত পরিবহন, লাব্বাইক পরিবহন, এলাইক ট্রান্সপোর্ট, দেওয়ান পরিবহন, খাজাবাবা পরিবহন, লাভলী পরিবহন, বিকল্প পরিবহনসহ ১৩/১৪টি কোম্পানির শতাধিক বাসের হেলপার ও চালকের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। দু’একজনের কাছে মাস্ক থাকলেও তা থুতনিতে ঝুলিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ হাতে নিয়ে যাত্রী ডেকে তুলছেন।
 
ঢাকা মেট্রো-ব ১৫৬২১৯ বাসের হেলপার নাম প্রকাশ না করে বলেন, অনেকদিন পর রাস্তায় বের হয়েছি। সরকার সবকিছু শিথিল করে দিয়েছে। রাস্তায় অনেক যাত্রী আছে। অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চালালেও, যাত্রীরা আমাদের কথা শুনতে চায় না। তারা লাফিয়ে লাফিয়ে বাসে উঠে। এতে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা সম্ভব হয় না।

রিয়াজ নামের একজন বলেন, ৮ দিনের জন্য বাস ছেড়েছে। মানুষ বাড়ি ফেরা ও রাজধানীর মধ্যে চলাচলের কারণে যানজট অনেক বেশি। মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকালে মাস্ক ও হ্যান্ডস্যানিটাইজার নিয়ে বের হয়েছি। হ্যান্ডস্যানিটাইজার শেষ হয়ে গেছে। বাস চলন্ত অবস্থায় মুখ থেকে মাস্ক পরে গেছে। এ ছাড়া তীব্র রোদ। এই গরমের মধ্যে মাস্ক পরে বেশি সময় থাকা যায় না। দেওয়ান সিটিং সার্ভিস (ঢাকা মেট্রো-ব ১৩১০৩৬) বাসের হেলপার জানান, মাস্ক পরে বেশি সময় থাকা যায় না। যাত্রী ডাকতে সমস্যা হয়। কিছু সময় পরপর ময়লা হয়ে যায়।

এদিকে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ দেখা গেছে দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চে। টানা ১৪ দিন বন্ধ থাকার পর ফিরছে আগের রূপে এসব পরিবহন। টার্মিনালগুলো এখন ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে উৎসবমুখর। মহাখালী, সায়েদাবাদ, গাবতলী, গুলিস্তান ও আব্দুল্লাহপুর বাস টার্মিনাল থেকে অর্ধেকের বেশি যাত্রী নিয়ে বাস ছেড়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উদ্দেশ্যে। নৌপথে বাড়ি ফিরতে সদরঘাটে  দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ ভিড় করছেন। সকাল থেকে একের পর এক ছেড়ে গেছে যাত্রীবাহী লঞ্চ। যাত্রীদের চাপ বেশি থাকায় টার্মিনাল কিংবা পন্টুনে মানা হচ্ছে না কোনো স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব।

অর্ধেক যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ থাকলেও তা মানছেন না লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। সকাল থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রায় লঞ্চেই গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হয়েছে। চাঁদপুরগামী প্রতিটি লঞ্চে পাশাপাশি সিটে ও ডেকে বসে যাত্রী নিতে দেখা গেছে। বিকালে বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীগামী লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ঘাট থেকে ছেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে নৌ-পুলিশ টহলে থাকলেও তাদের সামনেই মাস্ক ছাড়া ঘুরাঘুরি করছেন যাত্রীরা।

বাহাউদ্দিন নামের এক লঞ্চ স্টাফ জানান, ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষ বাড়ি ফিরছেন। অনেকদিন মানুষ ঢাকায় আটকে ছিলেন। লঞ্চ বন্ধ থাকায় গ্রামে যেতে পারেননি। এতে লঞ্চ চলাচলের প্রথম দিন যাত্রীদের চাপ একটু বেশি। যত সংখ্যক যাত্রী আছে, সে অনুযায়ী লঞ্চ নেই। অর্ধেক যাত্রী নিলে বাকি যাত্রীরা কোথায় কীভাবে যাবে। এজন্য যাত্রীরা তাড়াহুড়ো করে লঞ্চে উঠেন। এতে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হচ্ছে না।
 
ভোলাগামী যাত্রী মিজানুর রহমান বলেন, কোরবানি ঈদ পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য বাড়ি যাচ্ছি। ঈদের পর সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, গার্মেন্টস, শিল্প- কারখানাসহ বন্ধ। এ সময় ঢাকায় থাকলে নানা অসুবিধার মুখে পড়তে হতে পারে। এ ছাড়া খরচও বাড়বে। তার চেয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে এই সময়টা ভালোভাবে কাটাতে পারবো।

মার্কেটে উপচে পড়া ভিড়, নেই সামাজিক দূরত্ব: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দীর্ঘ ২২ দিন বন্ধ থাকার পর খুলে দেয়া হয়েছে শপিংমল ও বিপণি বিতান। আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে মার্কেটগুলোতে জমে উঠেছে কেনাকাটা। কঠোর লকডাউন শিথিলের প্রথম দিনে সকাল থেকে বিপণি বিতানগুলোতে দেখা গেছে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। গাদাগাদি করে ক্রেতারা শপিংমলে প্রবেশ করছেন। স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা না করে কেনাকাটা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা।

বিক্রেতাদেরও নেই কোনো স্বাস্থ্য সচেতনতা। মার্কেটে নেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থাও। ক্রেতাদের চাপ বাড়ায় ছিল না কোনো সামাজিক দূরত্বের বালাই। ক্রেতা-বিক্রেতাদের অনেকের মুখে মাস্ক থাকলেও কেউ কেউ আবার নাক থেকে সরিয়ে থুতনিতে রেখেছেন। করোনার ঝুঁকির মধ্যেও বড়দের সঙ্গে দেখা গেছে বয়স্ক ও ছোট শিশুদের। তবে মাস্ক ছাড়াও কেনাকাটা করতে দেখা গেছে অনেককে।

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা যায় কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। নেই হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার করার কোনো সুব্যবস্থা। দোকানিদের অনেকের মুখে ছিল না মাস্ক। হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার না করেই নাকে-মুখে হাত দিচ্ছেন অনেকে। একজনে একাধিক পোশাক শরীরে জড়িয়ে দেখছেন। ক্রেতারা ভিড় ঠেলে এক দোকান থেকে যাচ্ছেন অন্য দোকানে। 

মিরপুর-১ নাম্বার থেকে নিউমার্কেটে পাঁচ বছরের মেয়ে শিমুকে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছেন নাজমা আক্তার। মুখে তাদের কারও মাস্ক ছিল না। তিনি বলেন, শনিবার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ যাবো। এতদিন সবকিছু বন্ধ থাকায় কেনাকাটা করতে পারিনি। সেজন্য প্রথমদিনই কেনাকাটা করতে আসছি। আজই ঈদের সব কেনাকাটা শেষ করে বাসায় ফিরবো। মেয়ের জন্য কয়েকটি পোশাক কিনেছি। এখনো অনেক কেনাকাটা বাকি। অতিরিক্ত গরমের কারণে মুখের মাস্ক খুলে রেখেছি। মাস্ক পরতে আর ভালো লাগে না। শুধু মাস্ক পরে কি করোনা ঠেকানো যাবে। সামাজিক দূরত্বটাও তো কেউ মানছে না। এত ভিড় হবে ভাবতেই পারিনি।

মোশাররফ হোসেন মুগদা থেকে পরিবার নিয়ে এসেছেন গাউছিয়া মার্কেটে। দোকানে বসে সঙ্গে থাকা ছোট ছেলেমেয়েদের পোশাক দেখছেন। তার নিজের এবং স্ত্রীর মুখে মাস্ক থাকলেও নেই বাচ্চাদের মুখে। তিনি জানান, গরমে মাস্ক পরে ছেলেমেয়েরা থাকতে চায় না। এজন্য খুলে ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়েছি। করোনা হলে এমনিতে হবে। মাস্ক পরে কি হবে। কোনো দোকানেই তো স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। নেই কোনো সামাজিক দূরত্বও।

নিউমার্কেটের ওভার ব্রিজে পাঁচ বছরের শিশু সোহানাকে ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে কোলে নিয়ে পার হচ্ছেন বাবা সেলিম শেখ। নিজের মুখে মাস্ক থাকলেও ছিল না মেয়ের মুখে। তিনি জানান, মেয়ে মুখে মাস্ক রাখতে চায় না। করোনার ভয়ে মার্কেটে আসতে চাইনি। কিন্তু বাচ্চা মেয়েকে ঈদে কিছু কেনাকাটা করে না দিলে মন খারাপ করবে। এ জন্য মেয়েকে নিয়ে মার্কেটে আসা।

বিক্রেতা রাশেদ মিয়া জানান, মাস্ক পরে লাভ কি? আমাদের সারাদিন ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। মুখে মাস্ক রাখলে গরমে অনেক কষ্ট হয়। একাধিক ক্রেতাদের একই পোশাক বার বার দেখাতে হয়। বিক্রির পর টাকা হাতে নিতে হয়। এতে তো করোনার ঝুঁকি থেকে যায়। এরমধ্যে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবো। আমাদেরও তো জীবন বাঁচাতে হবে। করোনার টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক আমাদের। এমনিতে লকডাউনে সব শেষ হয়ে গেছে। সরকার আবারো লকডাউন দেয়ার কথা বলছে। তিনি আরও জানান, প্রথম দিন হওয়ায় বিক্রি ভালোই হয়েছে। আবার অনেক ক্রেতারা দেখাদেখি করে চলে যাচ্ছেন। আশা করি ঈদের আগে ভালোই বিক্রি হবে। ক্রেতাদের ভিড় আরও বাড়বে।