• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ৩১ আগস্ট, ২০২১ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

লুটের নায়ক মাহবুবকে শাস্তিমূলক বদলি

শীর্ষ কাগজ

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ) এর কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি-লুটপাটের হোতা হিসাব রক্ষক মাহবুবুর রহমানকে অবশেষে পটুয়াখালীতে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ এবং আমাদের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরে অফিসিয়ালি খোঁজখবর নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবশেষে বাধ্য হন তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বদলির ব্যবস্থা নিতে। 

গত ৩ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) এর স্বাক্ষরে মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমানকে আইপিএইচ থেকে পটুয়াখালী মির্জাগঞ্জের কাঠালতলী ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক পদে বদলি করা হয়। বদলির সঙ্গে সঙ্গে তাকে স্ট্যান্ড রিলিজও করা হয়। বদলির আদেশে বলা হয়েছে, “এই আদেশ প্রশাসনিক কারণে জারি করা হইলো এবং আদেশ জারির ০৩ (তিন) কর্মদিবসের মধ্যে ছাড়পত্র গ্রহণ করিতে হইবে। অন্যথায় ০৪ (চার) কর্মদিবসের দিন হইতে সরাসরি অব্যাহতি পাইয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।” 

এই বদলির আদেশ জারির পর শীর্ষ দুর্নীতিবাজ মাহবুবুর রহমান বিভিন্ন মহলে ব্যাপক তদবির চালিয়েছিলেন। কিন্তু সম্ভব হয়নি, যেহেতু স্ট্যান্ড রিলিজ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে।  

দেশের একমাত্র স্যালাইন উৎপাদনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ)। কিন্তু এখানে দীঘদিন ধরে দুর্নীতির রামরাজত্ব চালিয়ে আসছে একটি চক্র। বছরের পর বছর ধরে টেন্ডার ঘাপলা, অবৈধভাবে কোটেশন, ভুয়া বিল-ভাউচারসহ নানা রকমের অপকর্মের মাধ্যমে  কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছে চক্রটি। 

শুধু তাই নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমুহের সঙ্গে যোগসাজশে সরকারের স্বাস্থ্যখাতের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত করারও চক্রান্ত চালিয়েছে এই চক্র। এই চক্রেরই মূল হোতা মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, যিনি প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে হিসাব রক্ষকের পদে আছেন। এই প্রতিষ্ঠানে পরিচালকসহ বিভিন্ন পদের কর্মকর্তারা অন্যত্র থেকে নতুন পদায়ন হয়ে আসছেন, আবার বদলি হয়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু মাহবুব বহালই থেকে যাচ্ছেন। পরিচালকসহ অন্য পদগুলোতে যখন যিনি আসেন তাকে শুরুতেই মাহবুব ম্যানেজ করে নেন। এরপর নিজের ইচ্ছেমতো দুর্নীতি-লুটপাট চালাতে থাকেন। 

ইতিপূর্বে একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। অন্য গণমাধ্যমেও ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দুদক হাতেনাতে দুর্নীতি ধরেছে। বিভিন্ন সময়ে একাধিক তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। সেইসব তদন্ত কোনো না কোনোভাবে ধামাচাপা দিয়ে বহাল তবিয়তেই থেকেছেন মাহবুবুর রহমান। তবে সর্বশেষ চলতি বছরের প্রথমদিকে একটি তদন্ত কমিটি কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কোয়ারেন্টাইনের অর্থ আত্মসাতসহ বিভিন্ন দুর্নীতির প্রমাণের প্রতিবেদন দাখিল করে মাহবুবের বিরুদ্ধে। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু করে। বিভাগীয় মামলায় তার শুনানিও নেয়া হয়। কিন্তু দুর্নীতি প্রমাণের পর ফেব্রুয়ারি মাসে বিভাগীয় মামলা চালু হলেও অধিদফতর তার বিরুদ্ধে এতোদিন কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছিলো না। বরং এটি পুরোপুরি ধামাচাপা দেয়ার পাঁয়তারা চলছিলো। এরজন্য কোটি টাকার লেনদেনও হয়ে গিয়েছিলো। 

আমাদের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান এবং সুনির্দিষ্টভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে এ বিষয়ে জবাব চাওয়ায় অবশেষে অধিদফতর বাধ্য হয় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বদলির ব্যবস্থা নিতে। 
 
তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মাহবুবুর রহমান দুর্নীতি-লুটপাটের মধ্য দিয়ে সরকারের যে অর্থ আত্মসাত করেছেন এবং জীবন রক্ষাকারী স্যালাইন উৎপাদনকারী দেশের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট চক্রান্তমূলকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন- এজন্য শুধু বদলিই নয়, চাকরিচ্যুতি, জেল-জরিমানাসহ তার আরো কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।
 
ইতিপূর্বে দেশের সরকারি সব হাসপাতালে আইভি ফ্লুইড স্যালাইন সরবরাহ করত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ)। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এর উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। 

যদিও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ওষুধ প্রশাসন এর উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে কিন্তু নেপথ্যে রয়েছে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলো এবং আইপিএইচ এর দুর্নীতিবাজচক্রের যোগসাজশ ও সুগভীর ষড়যন্ত্র। আইপিএইচ এর স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ থাকার কারণে বাজারে বেড়েছে স্যালাইনের দাম, বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে রোগীদের। মাঝ থেকে রমরমা বাণিজ্য করছে বেসরকারি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। 

সরকারি এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বাজেটের ৬১ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে ওষুধে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় আইভি ফ্লইডে। জানা গেছে, আইপিএইচে গত ৫০ বছর ধরেই ২২ ধরনের স্যালাইন, ব্লাডব্যাগ, ট্রান্সফিউশন সেট উৎপাদন করা হচ্ছিল। এতে বছরে এক লাখের বেশি ব্লাডব্যাগ তৈরি হতো, যা দেশের মোট চাহিদার সাত ভাগের এক ভাগ। উৎপাদন করত বিভিন্ন ধরনের ১৪-১৭ লাখ স্যালাইন। এসব স্যালাইন কম দামে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা হতো। দামের প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছিল না বেসরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। 

অভিযোগ রয়েছে, উৎপাদনের মানসম্মত চর্চা নেই- এমন অজুহাতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২০১৯ সালের আগস্টে আইপিএইচের উৎপাদন স্থগিত করে। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক ও তৎকালীন সচিব (অব.) আসাদুল ইসলাম কারখানা পরিদর্শনের পর এটি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। এতে কলকাঠি নেড়েছে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। 
 
অবশ্য, এর আগে দীর্ঘদিন থেকেই জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন ধরনের স্যালাইন উৎপাদন বন্ধের চক্রান্ত চলছিলো। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন সরাসরি অভিযান চালিয়ে দুর্নীতিবাজদের চক্রান্ত ও অপকর্মের প্রমাণও পায় হাতেনাতে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) টিম ১ জুলাই, ২০১৮ মহাখালীতে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আকস্মিক অভিযান চালায়। উপ-পরিচালক সাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম স্যালাইন উৎপাদনকারী এই সরকারি প্রতিষ্ঠানে ওই দিন বেলা ১১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে। দুদক অভিযোগ কেন্দ্রে ১০৬-এ ফোন করে ভুক্তভোগী জনসাধারণের পক্ষ থেকে অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানকালে দুদক টিম সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে বেশ কিছু দুর্নীতি-অনিয়ম ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডের সন্ধান পায়। এ সময় ওই প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন পরিচালকও উপস্থিত ছিলেন। 

দুদকের কাছে অভিযোগ আসে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটিতে এক বছরে স্যালাইন উৎপাদন প্রায় বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে কাঁচামাল ক্রয় বন্ধ রাখায় স্যালাইন উৎপাদন শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ রেখে বেসরকারি স্যালাইন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে রমরমা বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। 

অভিযানকালে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তখনকার পরিচালক ডা. আবুল কালাম মো. আজাদ স্বীকার করেন, কাঁচামাল কিনতে না পারায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তিনি দাবি করেন, গত অর্থবছরে এ প্রতিষ্ঠানের বাজেটের ৮ কোটি টাকা ফেরত গেছে। কিন্তু, আরও বিভিন্ন খাতে প্রতিষ্ঠানের যে কোটি কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে সেগুলোর যৌক্তিকতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি পরিচালক ডা. আজাদ।

অভিযান পরিচালনা প্রসঙ্গে এনফোর্সমেন্ট অভিযানের সমন্বয়কারী দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হলেও কেউ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন। অবিলম্বে এ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গোচরে আনা হবে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোনো যৌক্তিক কারণ ও ভিত্তি ছাড়া উৎপাদন বন্ধ রাখাও এক ধরনের দুর্নীতি। অনুসন্ধানে এ দুর্নীতি প্রমাণিত হলে দুদকের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

কিন্তু জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট এতো শক্তিশালী যে, দুদকের ওই পদক্ষেপও তারা এক পর্যায়ে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে চক্রান্ত করে মন্ত্রণালয় ও ওষুধ প্রশাসনকে দিয়ে জনস্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউটের উৎপাদিত স্যালাইনসমুহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন রক্ষাকারী স্যালাইন আইভি ফ্লুইড উৎপদান একেবারে বন্ধই করে দেয়া এই চক্রটি।

উল্লেখ্য, এক সময় শুধু স্যালাইনই নয়, গুরুত্বপূর্ণ টিকাও উৎপাদন করতো জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। এমনকি বিদেশে রফতানিও করা হতো জনস্বাস্থ্য ইনস্টিউটের টিকা। কিন্তু এখন টিকা উৎপাদন দূরের কথা, ক্রমান্বয়ে স্যালাইন উৎপাদনের সক্ষমতাও হারাচ্ছে এই দুর্নীতিবাজচক্রের ধারাবাহিক চক্রান্তে।