• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ৪ নভেম্বর, ২০২১ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

বিচার শেষের আগেই ফাঁসি!

সমকাল

বিচারিক আদালত যদি কারও মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন, তার পরে ফাঁসি কার্যকরের আগে অন্তত চারটি ধাপ থাকে। প্রথমে হাইকোর্টে যায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য। সেখানেও রায় বহাল থাকলে আপিল বিভাগে রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করা যায়। এতেও নাকচ হলে রিভিউ বা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা যায়। তাতেও রায় না পাল্টালে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু বিচারের এসব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে আপিল শুনানির তারিখের দিন জানা গেল, চার বছর আগেই দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে।

এ দুই আসামি হলেন আবদুল মকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ূ। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর রাতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অথচ গতকাল বুধবার ছিল তাদের আপিল শুনানির দিন।

তবে যশোর কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, আইনগত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই মকিম ও ঝড়ূর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তাদের সরবরাহ করা নথিপত্রের অনুলিপিতে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর ওই সময়ের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ দুই আসামির চূড়ান্ত আপিল নিষ্পত্তি করেন। এরপর ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই আসামিদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয়। ওই বছরেরই ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সহকারী সচিব মোহাম্মদ আলী স্বাক্ষরিত পত্রে প্রাণভিক্ষার আবেদন নামঞ্জুরের বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। পরের মাস নভেম্বরের ১৬ তারিখ রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

অন্যদিকে আসামি মকিমের আইনজীবী হুমায়ুন কবির বলছেন, 'আপিলের শুনানি হলে আমরা জানতাম। আমার জানামতে, শুনানি হয়নি। এ বিষয়ে আপাতত আর কথা বলতে চাইছি না।'
এ আইনজীবীর ভাষ্য, 'হাইকোর্ট যখন তাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন (২০১৩ সালে), তখনই আপিল করা হয়। দীর্ঘ আট বছর পর বুধবার (গতকাল) আপিল শুনানির জন্য দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ১১ নম্বরে আসে। আপিলটি শুনানির জন্য প্রস্তুত করার সময় স্বজনদের কাছ থেকে জানতে পারি, চার বছর আগেই দ কার্যকর হয়ে গেছে।'

তিনি জানান, মূলত মকিম ও ঝড়ুর পরিবার খুবই দরিদ্র। তাদের পরিবারের সদস্যরা সেভাবে মামলার বিস্তারিত খোঁজ রাখতে পারেননি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপিল শুনানি নিষ্পত্তির আগে মৃত্যুদ কার্যকর সম্ভব নয়। সেটি কীভাবে হলো, কোনো অসংগতি আছে কিনা- তা খতিয়ে দেখতে হবে।

ফাঁসি কার্যকর হওয়া আবদুল মকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ূর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন একই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে অন্যদের সঙ্গে আবদুল মকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ুর নামও আসে। ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল তিনজনের মৃত্যুদ, দু'জনকে যাবজ্জীবন ও অপর ১৬ আসামিকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেন চুয়াডাঙ্গার ২ নম্বর অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক। মৃত্যুদ াদেশ পাওয়া তিনজন হলেন- একই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, আবদুল মকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ু। মকিম ও ঝড়ু নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।

এরপর বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদ াদেশ অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে। মামলার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ছিল ৩৯/২০০৮। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ৭ ও ৮ জুলাই হাইকোর্ট আসামি মকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদ বহাল রেখে রায় দেন। বাকি আসামিদের খালাস দেওয়া হয়।

পরে দুই আসামি মকিম (আপিল নং-১১১/২০১৩) ও ঝড়ু (আপিল নং-১০৭/২০১৩) মৃত্যুদ াদেশের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে আপিল করেন। তখন মকিমের পক্ষে আপিল মামলাটি পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবিরকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এরপর কেটে যায় আট বছর। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সম্প্রতি আপিল মামলাটি শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে। খবর দেওয়া হয় ওই দুই আসামি দরিদ্র মকিম ও ঝড়ূর পরিবারকে। মকিমের স্ত্রী এসে জানান, চার বছর আগে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর রাতে মকিম ও ঝড়ূর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তার আগে কারাগারে তারা শেষ সাক্ষাৎ করেছেন। ফাঁসি কার্যকরের পর লাশ এনে মেহেরপুরের ভোলাডাঙ্গা গ্রামে দাফন করা হয়।

আইনজীবী হুমায়ুন কবির বলেন, আজকে (বুধবার) মামলাটি তালিকায় থাকলেও শুনানি হয়নি। আগামী মঙ্গলবার (জেল আপিল) আপিল বিভাগে শুনানির জন্য রয়েছে। যেদিন শুনানি হবে ওই দিনই আদালতের দৃষ্টিতে বিষয়টি আনা হবে, চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে কীভাবে রায় কার্যকর হলো? ঘটনাটি যদি সত্যিই ঘটে থাকে তাহলে নিশ্চয় কারও না কারও ভুলে হয়েছে।

চূড়ান্ত আপিল নিষ্পত্তির আগে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। না জেনে কিছু বলা যাবে না।' সবকিছু জেনে আজ বৃহস্পতিবার ব্রিফ করবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মকিম ও ঝড়ূর মৃত্যুদণ্ড যখন কার্যকর করা হয়, তখন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার ছিলেন আবু তালেব। বিষয়টি নিয়ে তার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে বর্তমান জেলার তুহিনকান্তি খান দাবি করেছেন, দুই আসামির মৃত্যুদ কার্যকর করার বিষয়ে উচ্চ আদালতের লিখিত আদেশ তাদের কাছে আছে। দুই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। সেই নথিও আছে।

আপিল নিষ্পত্তির কপি ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নামঞ্জুরের কপি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আছে বলে দাবি করেন জেলার। তিনি বলেন, আমাদের কাছে যে নথিপত্র আছে তাতে দেখতে পাচ্ছি, সব ঠিক আছে। তারপরও কোথাও কোনো সমস্যা আছে কিনা, তা ঢাকা থেকে কাগজপত্র এলে বোঝা যাবে।
আসামি মকিমের স্ত্রী মোছা. ফারজানা বলেন, 'আমরা অশিক্ষিত মানুষ। একটা মাত্র ছেলেকে নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকি। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে একটাই হত্যা মামলা ছিল। চার বছর আগে তার ফাঁসি হয়। তার (মকিমের) ফাঁসি হওয়ার পর মেহেরপুরের ভোলাডাঙ্গা গ্রামে দাফন করা হয়। মামলা তো এখনও শেষ হয়নি।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, গণমাধ্যমে আসা ঘটনা যদি সত্য হয়ে থাকে, সেটা মারাত্মক দুঃখজনক। সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে কেন রায় কার্যকর করা হলো- এসব সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একটা নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি বা জুডিশিয়ারি তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তাহলে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, হাইকোর্টের রায়ের পর যদি আপিল আবেদন করার ক্ষেত্রে বিলম্ব হয়ে থাকে, তাহলে বিলম্ব মওকুফের জন্য আবেদন করতে হয়। আদালত যদি তা মওকুফ করে আপিল শুনানির জন্য মামলাটি গ্রহণ করেন, তাহলে আপিল নিষ্পত্তির আগে দ কার্যকরের কোনো সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) মো. ছগির মিয়া বলেন, 'আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কারাগারে ২০১৭ সালে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে'- এমন খবর তারা টিভিতে দেখেছেন। কারা কর্তৃপক্ষ সে সময়কার কাগজপত্র, ফাইল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে।