• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ৩ মার্চ, ২০২০ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

দুর্নীতি-জালিয়াতিতে সংকটে পড়েছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো

ক্রাইম প্রতিদিন ডেস্ক

 আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। আমানতকারীদের জমানো অর্থ নয়ছয় করেছেন চেয়ারম্যান, পরিচালক ও শীর্ষ নির্বাহী। এ অবস্থায় বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। আস্থার সংকট তৈরি হওয়ায় নতুন করে আমানত রাখতে চাইছেন না কেউই। এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও নতুন করে আমানত না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেয়াদ পার হওয়া আমানতগুলো ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করছে অধিকাংশ ব্যাংক।

কিন্তু ফেরত না দিয়ে তা পুনরায় নবায়নের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে চাপ প্রয়োগ করাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। শেয়ারের বাজারের মতো ধসনামা আর্থিক প্রতিষ্ঠাগুলোয়ও ব্যাংকগুলোকে অর্থ রাখতে বাধ্য করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি এক সভায় ব্যাংকের এমডিদের অনাপত্তি সত্ত্বেও সেখানে টাকা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়ে সরকারের কাছে সাহায্য চাইতে গতকাল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিদের প্রতিনিধিরা। আজ মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

অনিয়ম-জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশের পর থেকেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানতের পরিমাণ কমছে। গত মার্চে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৮ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা ৪৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

দেশে ব্যাংকবহির্ভূত ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৬টির চেয়ারম্যান-এমডিদের দুর্নীতির কারণে একেবারে সর্বস্বান্ত। পিপলস লিজিংয়ের বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বিআইএফসি, এফএএস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ফার্স্ট ফাইন্যান্স বন্ধের উপক্রম। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এমডি হিসেবে দায়িত্বপালন করে দুর্নীতির মাধ্যমে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রশান্ত কুমার হালদার।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এগুলো বন্ধের কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এর বাইরে চরম সংকটে না পড়লেও তারল্য সংকটে পড়েছে আরও প্রায় ২০ থেকে ২৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যেগুলো গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। মেয়াদ শেষে অর্থ ফেরত নিতে গেলে, না দিয়ে মেয়াদ বাড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। মেয়াদ বাড়াতে রাজি না হলেও টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন আমানতকারীরা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও সম্প্রতি আরেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ফেরত দিতে না পেরে খেলাপি হয়ে গেছে ৭ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সোনালী, রূপালী, অগ্রণীসহ কয়েকটি ব্যাংক ১৫ বার পর্যন্ত অর্থ ফেরত চেয়ে না পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অভিযোগ করেছে।

আগের অর্থ ফেরত না পেয়ে নতুন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেশকিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে আমানত না পেয়ে এবং আমানত ফেরত চাওয়ায় চাপে পড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিষয়টি সমাধান চেয়ে তারা গভর্নর ফজলের কবিরের সঙ্গে বৈঠক করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আবদারটি গত ব্যাংকার্স সভায় আলোচনায় আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওই আলোচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে উপস্থাপিত প্রতিবেদন নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের প্রায় ২৯ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে।

এ ছাড়া আমানত, ঋণ ও কলমানি মার্কেটসহ মোট তহবিলের ৭০ শতাংশই ব্যাংকগুলোর প্রত্যক্ষ অবদান। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান খারাপ অবস্থার সময় আমানত না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিকাংশ ব্যাংক। মেয়াদি আমানতগুলো নবায়ন না করে নগদায়ন করে নিচ্ছে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট আরও বাড়ছে। তারল্য সংকটের কারণে যথাসময় অর্থ ফেরত পাচ্ছে না জনসাধারণ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আস্থাহীনতার সংকটে পড়বে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এ আস্থার সংকট ক্রমান্বয়ে ব্যাংকিং খাতেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

ওই সভায় সোনালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান বলেন, মেয়াদ পূর্তির আগে কোনো অর্থ উত্তোলন করা হয়নি। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ ফেরত দেওয়ার অক্ষমতা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। অনেক প্রতিষ্ঠান সুদ বাবদ পাওনাও ফেরত দিচ্ছে না।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম বলেন, সুদ ফেরত পেলে আসল নবায়ন করতে কোনো অসুবিধা নেই। সুদ পরিশোধ না করা এবং তাদের ঋণ খারাপ হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন করতে হচ্ছে। এতে দুই দিক থেকেই ক্ষতি হচ্ছে।

মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি আহসান-উজ-জামান বলেন, ভাবমূর্তির কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত পাচ্ছে না। এ খাতের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

ইসলামি ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান মুনাফা প্রদান না করে, তা হলে অপরিশোধিত মুনাফার ওপর মুনাফা চার্জের সুযোগ নেই। মুনাফা পরিশোধ করলে আসল পুনর্বিনিয়োগে তাদের কোনো অসুবিধা নেই।

ব্যাংকের এমডিরা আরও জানিয়েছেন, পরিচালনা পর্ষদ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠান সুদ বাবদ অর্থ ফেরত দিচ্ছে না, তাদের কাছ থেকে আমানত ফেরত নিয়ে আসা এবং নতুন করে আমানত না রাখা। এ ক্ষেত্রে এমডিদের কিছুই করার নেই।

ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ব্যক্তি গ্রাহকদের আমানতও ফেরত দিচ্ছে না তারা। ব্যাংক নিজেও চায়না সব অর্থ তুলে তাদের বিপাকে ফেলতে। কিন্তু কোনো অর্থ ফেরত দেবে না, এটি গ্রহণযোগ্য নয়।

এ খাতে আস্থার সংকট একদিনে সৃষ্টি হয়নি। শৃঙ্খলা ফেরাতে মূলধন বাড়াতে হবে। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেবে না, আবার ডিভিডেন্ড দিয়ে মালিকদের পকেটে টাকা তুলে দেবে-এটি হতে পারে না। টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিভিডেন্ট ঘোষণায় বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।

এদিকে সংকট উতরাতে সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠক করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমডিদের সংগঠন বিএলএফসিএ। বৈঠকে তারা দুর্বল প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে পুনর্গঠন, তারল্য সংকট কাটাতে তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ সহায়তা, নীতি সহায়তা, রেমিট্যান্স সংগ্রহ বিতরণ এবং নতুন নতুন প্রডাক্ট চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে করছাড় সুবিধা দাবি করেছে। আজ মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টায় ওই প্রতিনিধি দল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলের কবিরের সঙ্গে বৈঠক করবে। বৈঠকে বিএলএফসিএর নতুন নির্বাহী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের এমডি মোমিনুল ইসলাম বলেন, দু-একটি প্রতিষ্ঠানের আমানতের অর্থ ফেরত না দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইমেজ সংকটে পড়েছে। এ সংকট কাটাতে আমরা চেষ্টা করছি। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সহযোগিতা চেয়েছি। পাশাপাশি অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছি। আশা করছি আমরা খুব শিগগির ইমেজ সংকট কাটিয়ে উঠব।