• ❐ www.crimeprotidin.com ❐ ৮ম বর্ষ ❐ ঢাকা ❐ ৭ মার্চ, ২০২০ ❐ dailycrimeprotidin@gmail.com ❐

কম্বোডিয়ায় মানবপাচার, স্টিকার ভিসায় স্মার্ট কার্ড ইস্যু বন্ধ

ক্রাইম প্রতিদিন ডেস্ক

আধুনিক কম্বোডিয়া বিনির্মাণের লক্ষ্যে চাইনিজ, জাপানিজ, কানাডিয়ানসহ বহু আন্তর্জাতিক কোম্পানি দেশটিতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ কারণে কম্বোডিয়ায় নতুন শ্রমবাজারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে বাংলাদেশের মানবপাচারকারীরা টার্গেট করেছে কম্বোডিয়াকে। অবৈধভাবে মানবপাচারের কারণে সেই সম্ভাবনা বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। মানবপাচার বন্ধ করতে এরইমধ্যে দুটি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া স্টিকার ভিসায় কম্বোডিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে স্মার্ট কার্ড ইস্যু বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে বিএমইটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, প্রতারণা বন্ধ করতে কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বুধবার (৪ মার্চ) এই মানবপাচারকারী ও দালালদের অপতৎপরতার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে।প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জাহাঙ্গীর আলম ও বিএমইটি’র পরিচালক (উপ-সচিব) মজিবর রহমান স্বাক্ষরিত এই চিঠিতে কম্বোডিয়ায় মানবপাচার প্রতিরোধে করণীয় এবং শ্রমবাজার সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য কম্বোডিয়া একটি সম্ভাবনাময় নতুন শ্রমবাজার। সেদেশে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প চালু হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের দক্ষ নির্মাণ (কনস্ট্রাকশন) শ্রমিকের অনেক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি অবৈধভাবে ও মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে মানবপাচার করে শ্রমবাজারটি বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে।’

কম্বোডিয়ার ফোকাল পয়েন্টের দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা ইতোমধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয়সহ সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক করেছি। মানবপাচার বিষয়ে আমরা সবসময় ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে থাকি। কম্বোডিয়ায় যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল অবৈধভাবে মানবপাচারের চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিস্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি কম্বোডিয়ায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। চাইনিজ, জাপানিজ ও কানাডিয়ান বহুজাতিক কোম্পানির সহায়তায় নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রাস্তা, হাউজিংসহ নানা প্রকল্পের কাজ চলছে। কম্বোডিয়ান নাগরিকদের মধ্যে পুরুষরা কনস্ট্রাকশনের কাজ করতে চায় না। এছাড়া, একজন চাইনিজ শ্রমিকের সমপরিমাণ বেতন দিয়ে সেদেশে তিন জন বাংলাদেশি শ্রমিক পাওয়া যায়। একারণে সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকের চাহিদা বেশি। এই সুযোগে বাংলাদেশের শতাধিক রিক্রুটিং এজেন্সি অবৈধভাবে ও জালিয়াতি করে কম্বোডিয়ায় লোক পাঠানো শুরু করেছে। কিন্তু অবৈধভাবে সেখানে যাওয়ার পর কম্বোডিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে এমপ্লয়মেন্ট কার্ড না পাওয়ায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন অনেকেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সম্প্রতি মাঈন উদ্দীন নামে একজন বাংলাদেশি নাগরিক ও মি. খোও নামে সিঙ্গাপুরের এক ব্যক্তি যৌথভাবে ‘ইসি বিল্ডার্স’ নামে কম্বোডিয়ায় একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চালু করে। ওই প্রতিষ্ঠান দেশীয় দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি ৩-৪ লাখ টাকার বিনিময়ে শতাধিক শ্রমিককে কম্বোডিয়ায় নিয়ে গেছে। কিন্তু ইসি বিল্ডার্সের দুই মালিক বৈধ কাগজপত্র ও কাজ দিতে না পেরে অফিস বন্ধ করে পালিয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, এই চক্রটি ভারত, সিঙ্গাপুর, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত কম্বোডিয়ার স্টেম্পিং ভিসা ও স্টিকার ভিসা ব্যবহার করে ভিজিটর হিসেবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কম্বোডিয়ায় পাঠাচ্ছে। সম্প্রতি পংকজ বিশ্বাস, রিপন আহমেদ, সেকেন্দার, ইদ্রিস, আজহার, মাইনুদ্দীন, সাইজুদ্দীন, রবীন্দ্রাথ কুণ্ডু ও জাকির নামে কয়েকজন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (লাইসেন্স নং ১৩৩৮) এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়। মন্ত্রণালয় ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনালের মালিক আব্দুর রহমান, ইসি বিল্ডার্সের কর্ণধার মাঈন উদ্দিন মি. খোও এর বিরুদ্ধে মানবপাচার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে।

সূত্র জানায়, পোর্ট সিটির বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে মন্ত্রণালয় এস এম সোলাইমান ইসলাম ওরফে রমজান নামে আরেক ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছে, যিনি রাজধানীর ফকিরেরপুল এলাকায় কম্বোডিয়ান জাল ভিসা প্রস্তুত চক্রের নেতা হিসেবে কাজ করছে। অভিযোগ আছে, এই চক্রটি থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের সাবেক প্রথম সচিব মনিরুজ্জামান এবং বর্তমান প্রথম সচিব ফাহাদ বসুনিয়ার স্বাক্ষর জাল করে সত্যায়িত ভুয়া চিঠি তৈরি করে। এভাবে কম্বোডিয়া যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে তারা অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া ওই চক্রটি কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনের গ্লোবাল মার্সেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের নাম ব্যবহার করে সেখানকার ‘বাজার ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড’ (মালিক রসিদ মোহাম্মদ) ও বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি ওসেন ব্লু ওভারসিজ (লাইসেন্স নং ১৩০৪) জাল কাগজপত্র তৈরি করে সাত জন শ্রমিক পাঠায়। কিন্তু নমপেন বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাদের কাগজপত্র জাল হিসেবে শনাক্ত করে তাদের আবার ফেরত পাঠিয়েছে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে তারা পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ও ওসেন ব্লু ওভারসিজ নামে দুটি রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভার বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। অন্যান্য যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি অবৈধভাবে কম্বোডিয়ায় মানবপাচার করছে, তাদের বিরুদ্ধেও খোঁজ-খবর নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে স্টিকার ভিসায় বহির্গমন ছাড়পত্র বা স্মার্ট কার্ড ইস্যু না করার জন্য নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, গত দুই বছরে ৮০০ শ্রমিক বৈধভাবে বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্ট ও বাংলাদেশি মালিকানাধীন কম্বোডিয়ান কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় গিয়েছেন। এদের মধ্যে যারা দক্ষ শ্রমিক তারা ওভারটাইমসহ মাসিক ৪ থেকে ৫শ’ মার্কিন ডলার আয় করছেন। যারা অদক্ষ শ্রমিক তারা ওভারটাইমসহ প্রতি মাসে ৩ থেকে ৫শ’ ডলার আয়  করছেন। তাদের স্বাস্থ্য সেবারও নিশ্চয়তা রয়েছে। আগামীতে কম্বোডিয়ায় অন্তত তিন লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের কাজের সুযোগ রয়েছে। দালাল ও মানবপাচারকারীদের কারণে কম্বোডিয়ার সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার নষ্ট করতে দেওয়া যাবে না।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা’র সভাপতি বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘লাইসেন্সধারী কিছু লোক কম্বোডিয়ার বাজারটা নষ্ট করার জন্য পাঁয়তারা করছে। আমরা  মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করছি। অসাধু এই চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘কম্বোডিয়ায় অনেক বড় একটা শ্রমবাজার হতে যাচ্ছে। শুরুতেই যদি ইমেজটা নষ্ট করে, তাহলে আমাদের জন্য এটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লিগ্যাল অ্যাকশন নিতে বলেছি।’