ভারতে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ করছে। মুসলমানরা লকডাউনের আদেশ অমান্য করেছে এবং ভাইরাস ছড়ানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারনা চালানো হচ্ছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে এসব নিয়ে হিন্দুদের টিটকারির কারণে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষও হয়েছে।
ভারতে বসবাসরত প্রায় ২০ কোটি মুসলমান বসবাস করে। তারা প্রায়শই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি বা ‘ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি’) নেতৃত্বে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়। হিন্দুদের আধিপত্য এবং হিন্দুদের জীবনযাত্রা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এমন একটি আদর্শ হ’ল হিন্দুবাদ, যা বিজেপির অন্যতম প্রধান বিশ্বাস।
এর ফলে সৃষ্ট ইসলামফোবিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণ জাল তথ্য বের হয়, যা প্রায়শই জাতীয়তাবাদী মিডিয়ায় প্রচারিত হয় এবং কখনও কখনও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি প্রকৃত সহিংসতা ও আগ্রাসনের জন্ম দেয়। এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল যখন ১৩ থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে নয়াদিল্লির নিজামউদ্দিন মারকাজ মসজিদে তাবলিগী জামায়াতের একটি সমাবেশ চলাকালীন বেশ কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
এপ্রিলের প্রথমদিকে, ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তারা এই প্রাদুর্ভাবের জন্য মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের দোষ দিয়েছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে, সমাবেশটি ভারতের ১৭ টি রাজ্য জুড়ে ১০২৩ টি সংক্রমণের জন্য দায়ি। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামফোবিয়া ও বিদ্বেষের এক তরঙ্গ উঠে আসতে শুরু করে। ‘কোরোনাজিহাদ’, ‘নিজামুদ্দিনইডিয়টস’ এবং ‘ব্যানজাহিলজামাত’ (জামায়াত আন্দোলন নিষিদ্ধ করো) এর মতো হ্যাশট্যাগগুলো ব্যবহার করে প্রায়শই ভুয়া ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে দাবি করা হয় মুসলমানরা কোভিড -১৯ প্রসারে চেষ্টা করছে।
এদিকে, করোনাভাইরাস পরীক্ষা এবং লোকজনকে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতে হিন্দু আর মুসলমান - উভয় সম্প্রদায়ের দোকান, বাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ আর বোমাবাজি হয়েছে। রোববার প্রথম উত্তেজনা তৈরি হলেও পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর থেকে নতুন করে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। গঙ্গা পাড়ের ওই এলাকায় বোমাবাজি আর আগুনের ধোঁয়া নদীর অন্য দিক থেকেও দেখা গেছে।
স্থানীয় সূত্রগুলি বলছে, কয়েকদিন আগে করোনাভাইরাস পরীক্ষার একটি শিবির করা হয়েছিল তেলেনিপাড়া এলাকায়। পরীক্ষায় প্রথমে একজন আর তারপরে আরও কয়েকজনের পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ঘটনাচক্রে তারা সকলেই মুসলমান। চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেট এলাকার অধীন তেলেনিপাড়া এবং লাগোয়া ভদ্রেশ্বর আর চন্দননগরের উর্দিবাজার এলাকায় বুধবার নতুন করে সংঘর্ষ হয় নি, কিন্তু উত্তেজনা রয়েছে এলাকায়। এখনও পর্যন্ত তিন দফায় মোট ১১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার হুমায়ূন কবীর।
ওই অঞ্চলে চটকল আছে, আর সেখানে হিন্দু এবং মুসলমানদের বসবাসের এলাকা মোটামুটিভাবে আলাদা। এক স্থানীয় বাসিন্দা বলছিলেন, ‘ক্যাম্পটা মুসলমান প্রধান এলাকায় হয়েছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই পজিটিভ এলে মুসলমানদেরই হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে হিন্দুদের একাংশ মুসলমান বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে। মুসলমানরাই করোনা ছড়াচ্ছে বলে টিটকিরি দেয়া হয়।’
তবে গোটা ঘটনার আরেকটা বর্ণনাও পাওয়া গেছে হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকে। তারা বলছেন করোনা সংক্রমিতরা কোয়ারেন্টিনে যেতে অস্বীকার করছিলেন বলেই হিন্দু প্রতিবেশিরাক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন সংক্রমণ তাদের মধ্যেও ছড়াতে পারে এই আশঙ্কায়। তাদের বক্তব্য সেজন্যই ব্যারিকেড করে দেয়া হয় ওই এলাকাটি।
কিন্তু এলাকার মুসলিমরা জানায় মুসলিম প্রধান এলাকাটি কেউ ব্যারিকেড তুলে বন্ধ করে দিয়েছিল, ফলে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। তার পরেই উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় মঙ্গলবার দুপুরে। ব্যাপক বোমাবাজি চলে, দোকান বাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
চটকল অধ্যুষিত এলাকাটিতে হিন্দু এবং মুসলমানদের বসবাসের এলাকা মোটামুটিভাবে আলাদা।
যেসব ছবি নানা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে হিন্দু-মুসলমান - উভয় পক্ষেরই দোকান বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। তবে বোমাবাজির ব্যাপারে একে অন্য পক্ষের ওপরে দায় চাপাচ্ছেন। ওই অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে যাতে কেউ গুজব ছড়িয়ে অশান্তি না বাড়াতে পারে। বিজেপির স্থানীয় সংসদ সদস্য লকেট চ্যাটার্জি পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল বলে অভিযোগ করেছেন।