মানুষকে ভালোবাসুন। লৈঙ্গিক, ধর্মীয় বা অন্য কোনো পরিচয় নয়, মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে ভালোবাসুন। দেখবেন, আপনি অচিরেই পৌঁছে গেছেন স্বর্গে। কারন মানুষের মধ্যে আছে অনন্তশক্তি আর বিরাট সম্ভাবনা, যার ফলে আপনি খুব তাড়াতাড়ি লাভ করবেন সেই অমিতশক্তি, পৃথিবীতে স্বর্গের স্পর্শলাভ এবং সবার জন্য বসবাসযোগ্য, শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত একটি অপরাধ মুক্ত বাংলাদেশ। বিশ্বাস না হলে একবার ভালোবেসেই দেখুন না।
ভালোবাসা ও সম্প্রীতি হলো পরশমণির মতো, যার সংস্পর্শে এলে মন থেকে হিংসা-বিদ্বেষ দূর হতে হতে একসময় শূন্যের কোঠায় এসে পৌঁছায়। লবণ পানিতে যেমন গলতে গলতে নিঃশেষ হয়ে যায়, তেমনি ভালোবাসার মাধ্যমেও মানুষের হিংস্র প্রকৃতি ও বিদ্বেষ প্রবণ আচরণ খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়। ভালোবাসা ও সম্প্রীতি কট্টর শত্রুকেও বন্ধুতে রূপান্তরিত করে, এমনকি দূরের অজানা-অচেনা কাউকেও আপন সহোদরের ন্যায় মায়া-মহব্বত করতে শেখায়। শত্রুভাবাপন্ন দ্বিপক্ষের মাঝে সমন্বয়-সমঝোতা ও ঐক্য সৃষ্টি করে এবং উভয়পক্ষকে এক মন-এক দেহের ন্যায় পরিণত করে।
ইসলামে ভালোবাসা-সৌহার্দ্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কোনো ব্যক্তিকে সৎকাজের প্রতি আহ্বান বা অপরাধ থেকে দূরে রাখতে গেলে আগে তাকে ভালোবাসতে হবে এবং তার প্রতি ভালোবাসা ও সম্প্রীতির আচরণ দেখাতে হবে। তাকে নিজের কাছে আপন করে নিতে হবে।
মানুষকে ভালোবাসার জন্য শুধুমাত্র আপনার ইচ্ছা শক্তিই যথেষ্ট। সুতারাং আসুন মানুষকে ভালোবাসি অপরাধ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ি। একটু ভেবে দেখুন, পৃথিবীতে কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না। অপরাধ কারো নেশা নয় (ব্যক্তি বিশেষের কথা আলাদা)। প্রতিটি মানুষই চায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য জীবন। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, মানুষ কেন অপরাধ করে? প্রতিকুল পরিবেশের কারণে, সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভূমিকার কারনে, পরিবার এবং সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারনে, রাষ্ট্রের তৈরি আইনের দূর্বলতার কারনে, বিচার ব্যবস্তার দূর্বলতার কারনে, নিজের ক্ষমতা বা স্বার্থের জন্য দূর্বলদের মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে দেওয়ার কারনে।
মানুষ কেন অপরাধ করে, এর সুনিদিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও, অপরাধবিদদের মতে অপরাধের মূল কারণগুলো হলো :
যখন অপরাধ করে ধরা পড়ার ঝুঁকির চেয়ে অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত সুবিধা বেশি হয়, তখন মানুষ এমন করে।
যখন অপরাধের মাধ্যমে অন্যদের সুবিধা পেতে দেখে, তখন নিজেও অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়।
কারো কারো মধ্যে অপরাধ করার একটা প্রবণতা থাকে। অর্থাৎ তার মধ্যে অপরাধ করার জন্য এক ধরনের জিনগত প্রস্তুতি নিয়েই তারা জন্মায়। পুরুষদের মধ্যে নারীদের তুলনায় আগ্রাসী আচরণ বেশি দেখা যায়। পুরুষদের মধ্যে আছে xy ক্রোমোজম, যেখানে নারীদের থাকে xx ক্রোমোজম। কিছু পুরুষের মধ্যে xyy ক্রোমোজম দেখা যায়। এদের মধ্যে অপরাধ করার হারও বেশি থাকে।
মানুষের মস্তিষ্কে ‘সেরোটনিন’ নামে এক ধরনের নিউরোকেমিক্যালের ঘাটতি থাকলে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
কেউ যদি অনেক বেশি পরিমাণে ‘স্টেরয়েড’ শরীরে নেয়, তবে তার মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ বেড়ে যেতে পারে।
মস্তিষ্কের কোনো অসুখ, যেমন—টিউমার, মস্তিষ্কে আঘাত, মস্তিষ্কে অপারেশনের সময়ে সৃষ্ট ক্ষতি ইত্যাদি কারণে মস্তিষ্কের আক্রমণাত্মক প্রবণতা নিয়ন্ত্রণকারী অংশের ক্ষতি হলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বদলে যেতে পারে এবং সে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
শৈশবে যারা ভালোবাসা পায় না, নির্যাতন ও ঘৃণার মধ্যে, অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের মধ্যে, বাস্তব ঝুঁকির মধ্যে যারা বেড়ে ওঠে; তাদের কারো কারো মধ্যে এই প্রবণতা থাকে।
যখন মানুষ উপলব্ধি করে যে সে যতই চেষ্টা করুক, তার আর্থিক অবস্থা উন্নতি করা একদম সম্ভব নয়, অথচ সে খুবই বঞ্চিত, তখন তার মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা বাড়তে পারে। সমাজ সম্পদশালীদের মূল্যায়ন করে। দরিদ্র সম্পদ পাওয়ার আশায় অপরাধ করে। সম্পদশালী আরো সম্পদের আশায় অপরাধ করে। তবে সম্পদশালীর তুলনায় দরিদ্ররা বেশি ধরা পড়ে। কারণ, সমাজ সম্পদশালীদের পক্ষে।
সমাজে যখন অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, যখন নৈতিকতার অবক্ষয় হয়, তখন এই সমাজের সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কোনটি নীতি, কোনটি নীতি নয় সেই ধারণা পরিষ্কার না থাকলে সমস্যা তৈরি হয়। ধর্ম আমাদের নৈতিকতা শেখায়। সমাজ নৈতিকতা রক্ষা করতে উৎসাহিত করে।
যাদের বাবা-মা বা ঘনিষ্ঠ যত্নগ্রহণকারী অপরাধী, তাদের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। কেননা, শিশু তার ঘনিষ্ঠজনকে দেখেই শিখে। যাদের বাবা–মা মাদক ব্যবহারকারী, তাদের মধ্যেও এমনটা হতে দেখা যায়।
যেসব পরিবারে নৈতিকতাকে মূল্যায়ন করা হয় না, অনৈতিক কাজের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা আছে—সেসব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি থাকে।
যেসব পরিবার কোনো কারণে একজন মাত্র অভিভাবক দিয়ে চালিত হচ্ছে, সেখানে শিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি দেখা যায়। যদি কোনো কারণে বাবা-মা দুজনই থাকেন, কিন্তু শিশুর প্রতি ভালোভাবে লক্ষ রাখতে না পারেন, তবেও এই ঝুঁকি বাড়ে। যদি কোনো কারণে শিশুর অন্যায় আচরণগুলো পুরস্কৃত হয়, তবে সে এই ধরনের আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে ও অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।
যেসব শিশু-কিশোর অপরাধপ্রবণ শিশু-কিশোরদের সঙ্গে মিশতে শুরু করে, তারাও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে। এ ধরনের দলে অপরাধ করার প্রতি এক ধরনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দেখা যায়।
ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র এলাকা, একসঙ্গে গাদাগাদি করে যেখানে অনেক মানুষ থাকে, সেখানে অপরাধপ্রবণতা বেশি দেখা যায়।
একবার যখন কোনো কারণবশত কেউ অপরাধ করে ফেলে, কোনো না কোনো কারণে ‘অপরাধী’ হিসেবে পরিচিত পায়, তখন তার মানবিক অধিকার গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হয়। রাষ্ট্র, সমাজ বা ধর্ম আর তাকে রক্ষা করে না। তখন তার জন্য আরো অপরাধ করাই সহজ হয় এবং অপরাধীদের সমাজে (সমাজের মধ্যে ক্ষুদ্র ও অচ্ছুত সমাজ) মেশাই তার জন্য সহজ হয়। সে আরো অপরাধ করে ধীরে ধীরে পাকা অপরাধী হয়ে ওঠে। কেউ হয়তো চরিত্রহীন কোনো আচরণে জড়িয়ে গেল। এখন চরিত্রহীনতা ছাড়া আর গতি নেই। পরিবার সরে গেছে। বাঁচতে তো হবে।
মাদক ব্যবহারকারী, অ্যান্টিসোশ্যাল ও বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার ধরনের মানসিক রোগে যারা ভুগছে, তাদের মধ্যে অপরাধের ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। যারা গুরুতর ব্যক্তিত্বের রোগে ভোগে, তাদের চিন্তাধারা, তাদের প্রতিক্রিয়া একদম অন্য রকম। তারা পৃথিবীটা নিজের মনে করে। অন্যেরও যেকোনো অনুভূতি থাকতে পারে, তারাও যে দুঃখ-কষ্ট পেতে পারে সেই অনুভূতি তার থাকে না। অনেকের, এমনকি নিজের প্রতিও মায়া থাকে না। অন্যের প্রতি মায়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তারা ভাবতে পারে, ‘আমাকে যেহেতু রাগিয়ে দিয়েছ বাছাধন, এখন তার ফল ভোগ করো’, ‘আমি যদি এখনই ওকে উপযুক্ত শাস্তি না দিই, তবে ও আমার মাথায় উঠে বসবে’, ‘ওর জন্য এটাই পাওনা’ ইত্যাদি।
অনেক সময় বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষগুলো আত্মহত্যা করে। আবার কেউ কেউ পরিবারের ঘনিষ্ঠজনকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করে। এক ধরনের নেতিবাচক বিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই তারা এটা করে। তারা ভাবতে পারে, ‘আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে আার পারছি না। মৃত্যুই আমার মুক্তির উপায়। আমার অবর্তমানে আমার সন্তান অনেক কষ্ট পাবে। তাই ওকেও নিয়ে যাই।’
মন আর মস্তিষ্কের একত্রে থাকার নাম একাগ্রতা। আর একাগ্রতার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে ভালোবাসা। আপনি ভালোবাসলে যেমন ভালো সময় কাটাতে পারবেন তেমনই আপনি শিখবেন কিভাবে রাগকে সামাল দিতে হয়, কিভাব মন খারাপের লাগাম টানতে হয়, কিভাবে ভালোবাসার মানুষের মনের মতো হতে হয়। লোহা পুড়ে যেমন সোনা হয় তেমনই ভালোবাসলে মানুষ পুড়ে হয় খাঁটি।
মাঝে মাঝে আত্মার সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ককেও অতিক্রম করে যায় (হুমায়ূন আহমেদ)।
ভালবাসা দিয়ে মরুভুমিতে ফুল ফোটানো যায় (ডেভিসবস)।
জীবনকে ঘৃণা কোরোনা ভালোবাসতে শেখো। ভালোবাসা দিয়ে এবং ভালোবাসা পেয়ে তোমার জীবনকে স্বর্গীয় সুষমায় উদভাসিত করে তালো (মিলটন)।
তুমি যদি কোনো লোককে জানতে চাও, তা হলে তাকে প্রথমে ভালবাসতে শেখো (লেলিন)।
মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)।
সুতারাং একমাত্র ভালোবাসাই পারে মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে এবং অপরাধীকে অপরাধ থেকে সরাতে।
কারও মনে যদি ভালোবাসা ও সম্প্রীতি না থাকে, তাহলে মানুষকে ভালো কাজের দাওয়াত দেওয়া ও মানব সমাজকে সঠিক পথের দিশা দেওয়া অসম্ভব। যুক্তিতর্কের ফুলঝুরি দিয়ে ও তথ্য-তত্ত্বের ভারে ন্যুব্জ করে যতটুকু সফল হওয়া যায়, তার চেয়ে বেশি সফল হওয়া যায় ভালোবাসা দীপ্ত হৃদয় ও অন্তর দিয়ে। উদাহরন সরুপ ধরেন একটা লোক চুরি করে আপনি তাকে ধরে মারলেন বা পুলিশের কাষ্টরিতে দিয়ে শাস্তি দিলেন, তাতে কি তার চুরি বন্ধ হবে। হবে না, তাহলে আপনাকে কি করতে হবে? চুরি করা ব্যক্তিকে ঢেকে ভালোবেসে কাছে বসিয়ে কিছু খাইয়ে চুরি করার অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে বুঝাতে হবে এবং জানতে হবে কেন চুরি করে? কারন অনুযায়ী সমাধান করতে হবে, তাহলেই সম্ভব ঐ ব্যক্তিকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে আনা।
যখন অপরাধ সংগঠিত হয়, তখন দুর্বলরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দরিদ্র অসহায় মানুষ, নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অপরাধীদের অপরাধ অনুপাতে যথাযথ শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের ভাবার দরকার, কেন অপরাধ হয়। কেন অপরাধ হয়, তার মধ্যেই নিহিত আছে অপরাধ প্রতিরোধের উপায়গুলো। সভ্য মানুষ হিসেবে আমাদের সবারই, ব্যক্তির, সমাজের, রাষ্ট্রের সবারই দায়িত্ব হলো অপরাধ প্রতিরোধ করা। ভালোবেসে, সমন্বিত প্রচেষ্টায় অপরাধের কারণগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অপরাধ কমতে কমতে একসময়ে শূন্যের কোটায় চলে আসবে এবং আমরা পাবো অপরাধ মুক্ত বাংলাদেশ।
সুতারাং আসুন সবাই মিলে এক সাথে কাজ করি, অপরাধ মুক্ত ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে আইন শৃঙ্খলা-বাহিনী ও সরকারকে সহায়তা করি।
লেখক
এ জেড এম মাইনুল ইসলাম পলাশ
সম্পাদক
ক্রাইম প্রতিদিন
প্রতিষ্টাতা ও চেয়ারম্যান
অপরাধ মুক্ত বাংলাদেশ চাই