বাংলাদেশে রোববার রাতে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা এবং তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই নতুন একটি আহবায়ক কমিটি গঠনের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এই আহবায়ক কমিটির প্রধান হয়েছেন বিলুপ্ত কমিটির আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী নিজেই।
সংগঠনটির এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত একাধিক নেতা বলেছেন, নানামুখী সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে শুধু অরাজনৈতিক এবং বয়স্ক নেতাদের দিয়ে এই কমিটি করা হয়েছে।
তবে হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে আকস্মিকভাবে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে সংগঠনের ভিতরেও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
হেফাজতে ইসলামের এ ধরনের সিদ্ধান্তের পেছনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে "সার্বিক পরিস্থিতি বা চলমান অস্থির এবং নাজুক পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়ার" কথা বলা হয়েছে। আর কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
তবে সংগঠনটির নেতাদের অনেকে বলে আসছিলেন, গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে তাদের সংগঠন চাপে পড়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে সরকারের সাথে হেফাজতের সমঝোতার চেষ্টাও দেখা গেছে।
এখন 'চাপের মুখে সমঝোতার অংশ হিসাবে', নাকি নিজেদের 'অভ্যন্তরীণ কারণে' - কমিটি বিলুপ্ত করে আহবায়ক কমিটি করা হয়েছে-এমন বিভিন্ন প্রশ্নে নানা আলোচনা চলছে।
হেফাজতের নতুন আহবায়ক কমিটির সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী বলেছেন, সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আহবায়ক কমিটি গঠনের বিষয়টি জরুরী হয়ে পড়েছিল।
"সরকারের সে রকম কোন চাপ নাই। সরকার কোন শর্ত দেয় নাই। এটা সমঝোতার কোন অংশ নয় বা সরকারের চাপে নয়। পরিস্থিতির কারণে এটা হেফাজতের কারণে জরুরি মনে করেছেন আমাদের আমীর" - বলেন নুরুল ইসলাম জেহাদী।
তবে এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, সে ব্যাপারে মি: জেহাদী বলেছেন, "সার্বিক বিষয় বলতে খুঁটিনাটি অনেক কিছু আছে। যেগুলো বিবেচনা করতে হয়েছে।"
"বিভিন্ন বক্তব্য বা বিভিন্ন জায়গায় আচরণের কারণে কিছু সংকট তৈরি হয়েছে, সেটাকেই সার্বিক বিষয় বলে এটা করতে হয়েছে। এটার প্রয়োজন ছিল" বলে তিনি মনে করেন।
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনাগুলো নিয়ে একশোটির বেশি মামলা হয়েছে, যাতে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাসহ অনেক নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
একইসাথে হেফাজতের একজন নেতা মামুনুল হককে নিয়ে নানা বিষয়ে বিতর্কও সংগঠনটিকে বিব্রতকর পরিস্থিতি ফেলে দেয়।
এসব নিয়ে সংগঠনটির ভেতরেও নানা প্রশ্ন ওঠে বলে এর একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
হেফাজতের কর্মকাণ্ড ঘনিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করেন লেখক শরীফ মোহাম্মদ। তিনি মনে করেন, সংগঠনের ঐক্য ধরে রাখা বা পরিচালনার সংকটও এ ধরনের পদক্ষেপের অন্যতম কারণ হতে পারে।
"হেফাজতে ইসলাম নানা কারণে একটা সংকটে পড়েছে। পরিচালনার সংকট বলি বা ধরে রাখার সংকট, সবাইকে নিয়ে চলার সংকট - এটারই একটা প্রকাশ ঘটেছে রোববার রাতে।"
শরীফ মোহাম্মদ আরও বলেছেন, "হেফাজতের ভেতরকার নানাজনের পদত্যাগ করতে চাওয়ায় যে একটা সংকট তৈরি হয়েছে, তা থেকে যেন একটা উত্তরণ ঘটানো যায়। সেটা একটা কারণ হতে পারে। "
"অথবা অনুমান করা যায়, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন রকম চাপ থাকতে পারে বা দলগত চাপ থাকতে পারে" - বলেন তিনি।
হেফাজতের নেতাদের অনেকে বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের সাথেও সম্পৃক্ত। এই ইস্যুও আবার আলোচনায় এসেছে।
শরীফ মোহাম্মদ বলছেন, "বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের সমন্বয় হয়েছিল হেফাজতের কমিটিতে। তাদের ভেতর থেকেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রেসার (চাপ) থাকতে পারে। যেটার সমন্বয় হয়েতো করা সম্ভব হচ্ছিল না হাইকমাণ্ডের পক্ষে। সেটাও হতে পারে" বলে তিনি মন্তব্য করেন।
হেফাজতে অভ্যন্তরীণ চাপ অনেকটা প্রকাশ্যেও এসেছে।
কয়েকদিন সংগঠনটির বিলুপ্ত কমিটির একজন নায়েবে আমীর পদত্যাগ করেছেন। আর কয়েকজন পদত্যাগ করার কথা বলেছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে আহবায়ক কমিটি গঠনের বিষয়কে সংগঠনটিকে টিকিয়ে রাখার কৌশল হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
তবে হেফাজতের নেতা নুরুল ইসলাম জেহাদী বলেছেন, বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতাদের তাদের সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে যেহেতু প্রশ্ন ওঠে, সেজন্য অরাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে এই আহবায়ক কমিটি করা হয়েছে।
"অরাজনৈতিক ব্যক্তি যারা আছেন, তাদের বা মুরুব্বী ও বয়স্ক নেতাদের নিয়ে আহবায়ক কমিটি করা হয়েছে। যদি এটার কোন সম্প্রসারণ হয়, তাহলে একই ক্যাটাগরির লোক দিয়ে তা করা হবে।"
মি: জেহাদী আরও বলেছেন, "হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন - কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে করা হয় - এরকম একটা কথা আছে। সেজন্য অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে আহবায়ক কমিটি করা হয়েছে।"
হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমীর আহমদ শফীর মৃত্যুর পর গত বছরের নভেম্বরে সংগঠনটির নতুন কমিটি গঠন করে আমীর হয়েছিলেন জুনায়েদ বাবুনগরী।
এই কমিটি গঠন নিয়ে তখন সংগঠনটির একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং প্রয়াত আমীর আহমেদ শফির ছেলে ও তার অনুসারীরা কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এখন সেই কমিটি বিলুপ্ত করে মি: বাবুনগরী আহবায়ক কমিটির প্রধান এবং বিলুপ্ত কমিটির মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী সদস্য সচিব হয়েছেন।
আকস্মিকভাবে এমন পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির নায়েবে আমীর এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামের একটি দলের নেতা আব্দুর রব ইউসুফী।
তিনি তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, "হেফাজতের কয়েক ডজন নেতা যখন রিমাণ্ডে এবং শত শত নেতাকর্মী জেলে বা গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন, এমন পরিস্থিতিতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে জুনায়েদ বাবুনগরী তার নেতৃত্বের কোয়ালিটি হারিয়েছেন" বলে তিনি মনে করেন।
এই ফেসবুক পোস্টের বাইরে মি: ইউসুফী আর কোন বক্তব্য দেননি।
ইসলামপন্থী বিভিন্ন দলের নেতা যারা হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটিতে ছিলেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, হেফাজতের যে নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন বা যারা গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের জন্য সংগঠনের এখনকার পদক্ষেপ ক্ষতিকর হতে পারে বলে তাদের ধারণা।
তারা বলেছেন, পরিস্থিতি সামলাতে হেফাজতের এই কৌশল কতটা ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে।
হেফাজতের সাথে ঘনিষ্ট বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, সরকারের চাপের পাশাপাশি সংগঠনের ভিতরেও অনেকের পদত্যাগসহ নানা মতের নেতাদের চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
সেই পরিস্থিতি সামলানোর বিষয়টিও কমিটি ভেঙে দেয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে বলে তারা মনে করেন।