উন্নত বিশ্বের একটি প্রভাবশালী দেশ কানাডা যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পথিকৃত বলে খ্যাত। কানাডা বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিকে কি কারণে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন ও বিপজ্জনক দল বলে বিবেচনা করে?
কেনই বা বিএনপির সদস্যদের কানাডায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বা অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় এ নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে বিএনপি নেতারা কোনোরূপ সাড়াশব্দ বা মাথা ব্যথা নেই... এখন নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে একটি বেসরকারি সংগঠন কর্তৃক খালেদা জিয়াকে সম্মাননা দেয়া নিয়ে।
খালেদা জিয়ার ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ সনদ লবিস্ট ফার্মের: মন্ত্রী শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ, খালেদা জিয়ার ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি' সনদ বিএনপির নিয়োগ করা লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তিকারী সংস্থা থেকে নেওয়া বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সাড়ে তিন বছর আগে নেওয়া এই সনদ গণমাধ্যমে দেখিয়ে বিএনপি খালেদা জিয়াকে হাস্যাস্পদ করেছে- বলেও মন্তব্য করেন তিনি (৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।
তথ্যমন্ত্রী এ বিষয় সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গণমাধ্যমে দেখলাম খালেদা জিয়াকে কানাডার একটি সংস্থা, যাদের নাম তেমন কেউ জানে না, জন্মও খুব আগে নয়, তারা তাকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, যেটি মির্জা ফখরুল সাহেব ২০১৭-১৮ সাল থেকে বলা শুরু করেছেন। এই সার্টিফিকেট আবার সাড়ে তিন বছর আগে ৩১ জুলাই ২০১৮ সালে দেওয়া। সাড়ে তিন বছর পর হঠাৎ বিএনপি নেতারা গণমাধ্যমের সামনে এসে কথাগুলো বললেন, তাতে পুরো বিষয় এবং খালেদা জিয়াকে একটি ‘লাফিং স্টক’ (হাস্যাস্পদ) বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ড. হাছান আরও বলেন, আপনারা জানেন যে কানাডার ফেডারেল আদালত বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে রায় দিয়েছিল। সেই কানাডার তথাকথিত এক সংস্থা থেকে বিএনপি একটি সার্টিফিকেট কিনেছে, সেটা আবার সাড়ে তিন বছর আগে। কিছু লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে বিএনপি তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা দিয়ে আবার কিছু ফার্মের সঙ্গে বিদেশিদের মাধ্যমে চুক্তি করেছে।
যে ‘অর্গানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’-এর পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে সনদ দেওয়া হয়েছে বলা হচ্ছে, তারা বিএনপির পক্ষ হয়ে দেশবিরোধী অপপ্রচার চালানোর জন্য লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। তাদের কাছ থেকে বিএনপি একটা সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছিলেন আর এখন সেটি গণমাধ্যমের সামনে দেখালেন, পুরো বিষয়টাই হাস্যকর। মন্ত্রী এ সময় চুক্তিপত্রের কপি সাংবাদিকদের দেখান…।
বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দল বিএনপির ওপর কোন বিবেচনায় আইআরবির নেয়া এমন সিদ্ধান্ত যে বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন ‘তা আবার কানাডার ফেডারেল আদালত সমুন্নত করেছে যা পর্যালোচনা দাবি রাখে। বিএনপি বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক দল, এটি বিভিন্ন সময়ে সরকার গঠন করেছে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিরোধী দলে ও বসেছে। একজন ব্যক্তি যিনি বিএনপির সদস্য, তিনি সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য হতে পারেন বা নাও হতে পারেন।
ফেডারেল কোর্ট এ সমস্যাটি স্বীকার ও করেছে তারপর ও যে, বিএনপিকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখা গেছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে নয়, এ সমস্যার কোনো সমাধান বের করতে সক্ষম হয়নি কানাডার ফেডারেল আদালত ।
এর অর্থ দাঁড়ায় কানাডার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে মন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত কোনো সংস্থার বিবেচনায় বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। যদিও জননিরাপত্তা মন্ত্রী একটি তালিকা রাখেন এবং সে তালিকায় এমন ব্যক্তি ও সংস্থা রয়েছে যারা কানাডা সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত বলে নির্ধারণ করেছে। তবে, যারা কানাডায় প্রবেশ করতে বা থাকতে চান তাদের জন্য এখানেই এ গল্পের শেষ নয়।
বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন ও কানাডায় প্রবেশে জন্য সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। মন্ত্রী আরেকটি তালিকা রয়েছে যেখানে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি প্রোটেকশন অ্যাক্ট (IRPA) এর ধারা ৩৫(১)(বি) অনুসারে:৩৫ (১) একজন স্থায়ী বাসিন্দা বা একজন বিদেশী নাগরিক মানবিক বা আন্তর্জাতিক অধিকার লঙ্ঘনের কারণে এ দেশে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন- মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ আইনের ৬(৩) থেকে (৫) পর্যন্ত এ তালিকায় শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদে নিয়োজিত বিদেশী সরকারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
এ ধরনের মনোনয়নের সিদ্ধান্ত খুবই রাজনৈতিক এবং এর ফলস্বরূপ বর্তমানে শুধুমাত্র কয়েকটি সরকার এ তালিকার আওতাভূক্ত এবং যা খুব সীমিত সময়ের জন্য বলে ধরে নেয়া যায়. কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী যেহেতো বিষয়টি দেশের উচ্চ আদালতের মাধ্যমে স্বীকৃত হয়ে রয়েছে।
আই.আর.পি.এ এর ৩৪(১)(সি) ধারায় বলা হয়েছে যে সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত একজন ব্যক্তি কানাডা প্রবেশের জন্য অগ্রহণযোগ্য হবে। যদিও এদেশের ফৌজদারি কোডে ও সন্ত্রাসবাদকে এ মর্মে সংজ্ঞায়িত করেছে যে একজন ব্যক্তি সন্ত্রাসে জড়িত ছিল তা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে, ওই ব্যক্তির ব্যক্তিগত আচরণের প্রমাণের উপর নির্ভর করা হবে।
একজন স্থায়ী বাসিন্দা বা একজন বিদেশি নাগরিককে যখন ৩৪ (১) ধারায় নিরাপত্তার কারণে কানাডায় অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা হয় তখন স্থায়ী বাসিন্দা বা অভিবাসন প্রত্যাশীদেরও এতে আতংকিত হওয়ার কারণ রয়েছে।
জানা গেছে বেশ কিছু অভিবাসন প্রত্যাশী বিতাড়িত হওয়ার জন্য বর্তমানে অপেক্ষায় রয়েছেন। বিএনপির মতো এমন একটি সংস্থার সদস্য হওয়া যা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যে অনুচ্ছেদ (এ), (বি), (বি.১) বা (সি) এ উল্লেখ করা কাজগুলিতে সে জড়িত, নিযুক্ত বা নিযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত আচরণ এখানে অপ্রাসঙ্গিক, সন্ত্রাসী আচরণে ও ব্যক্তির কোনো জ্ঞান রয়েছে কিনা তাও অপ্রাসঙ্গিক।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন কতগুলো কর্মকাণ্ড তাদের অবশিষ্ট ইমেজকে ও নষ্ট করে দিয়েছে। সরকার হটাতে জাতিয় স্বার্থ পরিপন্থী ও রাষ্ট্রবিরোধী লক্ষ্য অর্জনে লবিস্ট নিয়োগ, বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আন্দোলনের নামে হটকারিতা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কংগ্রেসম্যানদের কাছে প্রেরিত চিঠি, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থতা, অন্য কোনো পদ্ধতিতে তৃতীয় কোনো শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে ব্যর্থ প্রচেষ্টা, বিএনপির এখন রাজনীতিই হচ্ছে শুধুমাত্র কয়েকটি বিবৃতি এবং সংবাদ সম্মেলনের।
বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন এর সমালোচনা করছেন এবং বিএনপি পথ হারিয়েছে বলে মনে করছেন। কানাডায় বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন চিহ্নিত হওয়ার তকমাকে মাথায় নিয়ে একটি বেসরকারি সংগঠন কর্তৃক খালেদা জিয়াকে সম্মাননা দেওয়ার নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করার মাধ্যমে একজন প্রবীণ ও অসুস্থ মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছে।