চীন চলতি সপ্তাহের মধ্যেই জাতীয় পর্যায়ে ব্লকচেইন চালু করতে যাচ্ছে চীন। ব্লকচেইন-বেইজড সার্ভিস নেটওয়ার্ক (বিএসএন) নামে চলতি সপ্তাহেই এটি চালু করা হবে বলে জানিয়েছে কয়েন ডেস্ক। বিএসএন হচ্ছে চীনের জাতীয় ব্লকচেইন কৌশলের সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল অংশ, যা গত নভেম্বরে ঘোষণা করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
চলতি সপ্তাহেই জাতীয় পর্যায়ে এটি চালু করবে চীন। আসছে জুনে তা বৈশ্বিকভাবে উন্মোচন করা হবে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল মুদ্রার লেনদেনে আমুল আসতে পারে।
ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে দেশের কোনও কোনও সিটিতে পরীক্ষামূলকভাবে এই ব্লকচেইনের ব্যবহার শুরু করেছে চীন। খুব শিগিগিরই এটি জাতীয়ভাবেও চালু করার পথে এগোচ্ছে দেশটি।
ব্লকচেইনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্টের ডলারের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে চীন। এমনটি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে ভয়েস অব আমেরিকার ওই প্রতিবেদনে।
ব্লকচেইন কী?
ব্লকচেইন হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণ করার একটি নিরাপদ এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে তথ্য বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি চেইন আকারে সংরক্ষণ করা হয়। এটি একটি অপরিবর্তনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যই প্রযোজ্য নয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকোনও কার্য-পরিচালনা রেকর্ড করা যেতে পারে। এটা এমন একটি বন্টনযোগ্য ডাটাবেজ যাতে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলির মধ্যে সব লেনদেনের নথি করে রাখা যায়। প্রতিটি লেনদেন আবার সিস্টেমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা যাচাই করা হয়। একবার লেজারে কোনো তথ্য প্রবেশ করলে স্থায়ীভাবে তা থেকে যায় এবং কখনো মুছে ফেলা যায় না। ব্লকচেইন প্রতিটি একক লেনদেনের যাচাইযোগ্য রেকর্ড নিয়ে গঠিত হয়। এই অন্তর্নিহিত প্রযুক্তি নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন কাজে এটির প্রয়োগ করা যেতে পারে।
যেহেতু ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারে ডিজিটাল তথ্যসমূহের নিরাপত্তার সঙ্গে আপস না করেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিজিটাল তথ্য যাচাই করা যায়, সেহেতু এটি প্রয়োগ করে ডিজিটাল বিশ্বে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। ব্লকচেইন প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ হলো ‘স্মার্ট কন্ট্রাক্ট’। এটি মূলত একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি চুক্তির শর্তাবলি সম্পাদন করতে পারে। আরেকটি নির্ভরযোগ্য প্রয়োগ হলো- এই স্মার্ট চুক্তি ব্যবহার করে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ন্ত্রণ, যাকে ‘স্মার্ট প্রোপার্টি’ বলা হয়।
ব্লকচেইন যেভাবে কাজ করে
অন্যান্য ডাটা বেইসের মতো ব্লকচেইনেও রেকর্ড হিসেবে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিটি রেকর্ডকে বলা হয় ব্লক। প্রতিটি ব্লকে তথ্যের সঙ্গে পূর্ববর্তী ব্লকের ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ এবং টাইম স্টাম্প যুক্ত করা থাকে, পাশাপাশি আরো থাকে ট্রানজেকশন ডাটা। ‘ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ’ হচ্ছে, একটি ব্লক তৈরির পর তার বিশেষত্বগুলো নিয়ে তৈরি করা একটি কোড। কোনো কারণে যদি ব্লকটিতে পরিবর্তন করা হয়, তাহলে তার ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশও বদলে যায়। ব্লকে থাকা রেকর্ড কোন ব্যক্তি কখন যুক্ত বা পরিবর্তন করেছেন তা দেওয়া থাকে টাইম স্টাম্প এবং ট্রানজেকশন ডাটায়। আর ব্লকগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলে তৈরি হয় ‘ব্লকচেইন’। তথ্যের পরিমাণ যত বাড়বে, চেইনে তত বেশি ব্লক যুক্ত হবে। চেইনে প্রয়োজনে অসীম সংখ্যক ব্লকও যুক্ত করা সম্ভব।
যখন ব্লকচেইনের তথ্য কোনো ব্যবহারকারী দেখবেন বা পরিবর্তন করতে চাইবেন, তখন তাঁর কাছে পুরো চেইনটিই পাঠানো হবে। এভাবে কোনো কেন্দ্রীয় সার্ভার ছাড়া শুধু ব্যবহারকারীদের ডিভাইসে অগণিত কপি সংরক্ষণের মাধ্যমে ব্লকচেইন টিকে থাকতে পারে। এ ধরনের সার্ভারবিহীন তথ্য সংরক্ষণ ও আদান-প্রদানের উপায়কে বলা হয় ‘পিয়ার টু পিয়ার নেটওয়ার্কিং’।
পুরো চেইনের প্রতিটি কপি যে ডিভাইসগুলোতে আছে, তাকে বলা হয় ‘নোড’। প্রতিবার নতুন ব্লক যুক্ত বা পরিবর্তন হলে প্রতিটি নোডেই সঙ্গে সঙ্গে তা আপডেট করা হবে। ফলে নতুন তথ্য প্রত্যেক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যাবে নিমেষেই।
ক্রিপ্টোকারেন্সি কী
‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’ সহজ ভাষায় ‘ডিজিটাল মুদ্রা’। বাজারে চালু প্রতিটি ক্রিপ্টোকারেন্সি মূলত একেকটি গাণিতিক সংকেত। ক্রিপ্টোকারেন্সি চাইলেও নকল করা যায় না।
এক ব্যবহারকারী যখন ক্রিপ্টোকারেন্সি তাঁর ওয়ালেটে রাখবেন, তখন সে ডাটাটুকু শুধু তাঁর ওয়ালেটেই থাকবে। ফলে অন্য কোনো ব্যক্তি চাইলেও কারেন্সি লেনদেনে একই ডাটা ব্যবহার করতে পারবেন না।
‘বিটকয়েন’ বিশ্বের প্রথম জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি। এ ছাড়া ‘মনেরো’, ‘লাইটকয়েন’ এবং অন্য আরো অনেক ক্রিপ্টোকারেন্সিও বর্তমানে লেনদেনে ব্যবহার হচ্ছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি যেহেতু কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না, তাই তার মূল্য সরাসরি বাজারের চাহিদা এবং সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। আবার কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক না থাকায় ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে কেউ চাইলেও হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
ব্লকচেইন ও ক্রিপ্টোকারেন্সি
বিটকয়েনের সঙ্গে ব্লকচেইন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিটকয়েন লেনদেনের হিসাব রাখার জন্যই ব্লকচেইন প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছিল। অন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবস্থাগুলোও ব্লকচেইনের মাধ্যমেই ট্রানজেকশনের হিসাব রাখে। কিন্তু ব্লকচেইন আর ক্রিপ্টোকারেন্সি এক নয়।