গত কয়েক বছর ধরে ঈদে চামড়া নিয়ে তৈরি হয়েছে সঙ্কট। সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা না হলে এবারো বাংলাদেশে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে গতবারের মতো বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ এবং চামড়ার ব্যবসায়ীরা।
বিশেষজ্ঞ এবং চামড়ার শিল্পের সাথে জড়িতরা বলছেন, এবারো একই ধরণের ঘটনা ঘটার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। বরং এবার সেই আশঙ্কা আরো বেশি রয়েছে বলেও মত দিয়েছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গতবারের তুলনায় এবার বাজারে চামড়ার চাহিদা আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আর এটা শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার নয় বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১৯ সালে ঈদ-উল আযহার পর কোরবানির পশুর চামড়ার দাম এতোটাই নিম্নগামী হয় যে বিষয়টি অনেকের মাঝেই বিশেষ করে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশার তৈরি করে।
উপযুক্ত দামে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে অনেকে সেগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলা কিংবা ফেলে দেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে প্রকাশিত হয়।
সেসময় এসব ঘটনাকে 'বিপর্যয়ের' সাথে তুলনা করেছিলেন অনেকে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "গতবারের তুলনায় এবছর বাজারে চামড়ার চাহিদা আরো কম। কারণ গতবার যে চামড়া কেনা হয়েছিল তার প্রায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এখনো অবিক্রীত রয়ে গেছে।"
"প্রক্রিয়াজাত করা এসব চামড়া ট্যানারিগুলোতে এবং কারখানাগুলোতে রয়ে গেছে।"
একই ধরণের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান।
তিনি বলেন, যদি ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীদের পর্যাপ্ত ঋণ দেয়া না হয় তাহলে গতবারের মতো অবস্থা হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
তার দাবি, "ঋণ পেলে একটা চামড়াও রাস্তায় পড়ে থাকবে না।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত করা চামড়ার অন্যতম আমদানিকারক চীন। সে দেশটিও এখন চামড়া নিচ্ছে না। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চামড়ার পণ্যের উপর যে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে তার কারণেও দেশটিতে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমে গেছে।
ফলে বাংলাদেশ থেকে চীনে যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হয় তা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর পেছনে কোভিডও একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়বে না বলে মনে করছেন মি. খন্দকার।
"সব মিলিয়ে ট্যানারি বা ফ্যাক্টরিগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে চাহিদা যেমন তেমন একটা নেই, ঠিক তেমনি তাদের আর্থিক পরিস্থিতিও সেইভাবে সহজতর না এখন," তিনি বলেন।
এছাড়া দেশে কোরবানির পশুর খামার বেড়ে যাওয়ায় এবছর ৭ লাখ কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকার কথা রয়েছে বলে জানান এই গবেষক।
এছাড়া এ বছর কোরবানি কম হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এই ধরণের পশুর সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এসব পশু জীবিত বা এর মাংস প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা যায় কিনা সে বিষয়টিও সরকারের মাথায় রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার বলেন, যেহেতু দেশীয় বাজারে চাহিদা কম তাই কাঁচা চামড়া রপ্তানির বিষয়টি উন্মুক্ত রাখতে হবে।
এছাড়া লবণ দিয়ে যে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয় যেটি হোয়েট-ব্লু চামড়া নামে পরিচিত সেটিও রপ্তানির জন্য উন্মুক্ত রাখাটা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া চামড়া ব্যবসায়ের সাথে জড়িত মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম কমলে ক্ষতির মুখে পড়েন উল্লেখ করে খন্দকার বলেন, এক্ষেত্রে চামড়া সংরক্ষণের জন্য যে লবণ ব্যবহার করা হয় সেটির দাম বেড়ে গেলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েন।
সেক্ষেত্রে এই সময়ে লবণের দাম বাড়ে কিনা বা লবণের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণে রাখাটাও জরুরী বলে মত দেন তিনি।
এদিকে এরআগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, প্রয়োজনে চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দেয়া হবে।
চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্তের সাথে একমত হওয়ার কথা জানিয়েছেন চামড়া ব্যবসায়ের সাথে জড়িতরাও।
বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, চামড়া রপ্তানির বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন তারা।
তিনি মনে করেন, এ বিষয়টি চালু হলে ট্যানারি ও কারখানায় যে চামড়ার স্তূপ হয়ে আছে সেটি আর থাকবে না।
তবে শুধু র-হাইড বা কাঁচা চামড়া নয় বরং ১৯৯০ সাল থেকে বন্ধ থাকা হোয়েট-ব্লু চামড়া রপ্তানিরও সুযোগ করে উচিত বলে মনে করেন তিনি।
"হোয়েট-ব্লু চামড়া যদি রপ্তানির সুযোগ করে দেয়া হয় তাহলে অনেক কন্টাক্ট আসবে, ব্র্যান্ড-বায়ার আসবে। তবে এগুলো হতে একটু সময় লাগবে, কিন্তু হয়ে যাবে।"
২৬ জুলাই বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি চামড়া ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাদের এক অনলাইন বৈঠকে এ বছরের চামড়ার দর ঘোষণা করেন।
যেখানে বলা হয়, এ বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দর ২৮ থেকে ৩২ টাকা।
গত বছর ঢাকায় এই দাম ছিল ৪৫-৫০ টাকা, এ বছর দাম কমানো হয়েছে গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৯% কম।
আর ঢাকার বাইরে গত বছর গরুর চামড়ার দাম ছিল ৩৫-৪০ টাকা, যা এবারে প্রায় ২০% কমানো হয়েছে।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাগলের চামড়ার দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩-১৫ টাকা। গত বছর এই দাম ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। গত বছরের তুলনায় ছাগলের চামড়ার দাম কমেছে প্রায় ২৭%।
চামড়ার দাম নির্ধারণ করা নিয়ে সুলতান বলেন, চামড়ার দাম এবার কম করে নির্ধারণ করাটা যৌক্তিক হয়েছে। এতে ঝুঁকি কমে আসে বলে মনে করেন তিনি।
"দাম কমিয়ে ভাল হয়েছে। আগে যেখানে এক হাজার চামড়া কিনতে ২৫-৩০ লাখ টাকা লাগতো। এখন সেখানে ৫ লাখ টাকা লাগে। এটা লোডও কম, রিস্কও কম, সব দিক দিয়ে ভাল।"
তবে অনেকের কাছে চামড়ার দাম কমিয়ে দেয়াটা তারা ভাল মনে করছেন না বলেও জানান মি. সুলতান। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, এবার ব্যাংক থেকে চামড়া ব্যবসায়ীদের ৬৮০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার কথা রয়েছে। এই অর্থ পাওয়া গেলে চামড়ার দাম কমবে না এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়বে না বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, গতবারের মতো চামড়ার বাজারে এবার তেমন ধস আসবে না বলে আশা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো: জাফর উদ্দীন বলেন, এবার চামড়ার বাজারের অবস্থা গতবারের মতো হবে না বলে আশা করছেন তারা।
গতবারের মতো অবস্থা ঠেকাতে দরকার হলে চামড়া রপ্তানি করার বিষয়টি অনুমোদন দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
জাফর উদ্দীন বলেন, "পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। যদি দেখা যায় যে, অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা কম এবং চামড়ার যোগান রয়েছে, সেক্ষেত্রে রপ্তানির অনুমোদন দেয়া হতে পারে।"