২০১৯ সালের আগস্ট মাসের কথা। পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় রূপা নামে এক স্কুল শিক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে নড়াইলের কয়েক কিশোরকে। 'নড়াইল ভলান্টিয়ার্স' নামের একটি সংগঠন ছিল তাদের। স্বেচ্ছায় রক্তদান করত তারা, কম্বল বিতরণ করত গরিবদের মধ্যে, খাবার পৌঁছে দিত পথশিশুদের। রূপার মৃত্যুর পর তাদের মনে হলো, শিশু-কিশোরদের সাইবার বুলিংয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য সচেতনতামূলক একটা কর্মসূচি দরকার।
এভাবেই একসময় যাত্রা শুরু করেছিল 'সাইবার টিনস'। আর তা সম্ভব হয়েছিল কিশোর সাদাত রহমানের অদম্য চেষ্টায়। এই পথে হেঁটেই ২০২০ সালে 'শিশুদের নোবেল' হিসেবে পরিচিত 'চিলড্রেন পিস অ্যাওয়ার্ড' বা 'শিশু শান্তি পুরস্কার' অর্জন করেন সাদাত। বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের সাইবার বুলিংয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য সংগঠিত সচেতনতামূলক প্রচার এবং সাইবার টিনস নামে একটি অ্যাপ নির্মাণ করে তিনি এ পুরস্কার অর্জন করেন। শিশু অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটিই বাংলাদেশের প্রথম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার।
২০০৫ সালে ইতালির রাজধানী রোমে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের একটি সম্মেলন থেকে এই পুরস্কার প্রবর্তনের ঘোষণা দেয় 'কিডস-রাইটস' নামের একটি সংগঠন। বলা হয়, শিশু অধিকার নিয়ে যারা কাজ করবেন, তাদের মধ্য থেকে ১৮ বছর বয়সের কম একজন সংগঠককে দেওয়া হবে এ পুরস্কার, যা পরবর্তী সময়ে পরিচিতি পেয়েছে 'শিশুদের জন্য নোবেল' পুরস্কার নামে। বাংলাদেশের আগে এই উপমহাদেশে ২০০৬ সালে ভারতের শিশু অধিকার কর্মী ওম প্রকাশ গুলজার এবং ২০১৩ সালে পাকিস্তানের মালালা ইউসুফ জাই এ পুরস্কার পান। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনের অংশ হিসেবে অসাধারণ
আলাপকালে বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সাদাত রহমান জানিয়েছেন, এতদিন সাইবার টিনসের কার্যক্রম সীমিত ছিল শুধুমাত্র নড়াইল জেলায়। আগামী নভেম্বর মাস থেকে 'সাইবার-টিনস'-এর কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে ৬৪টি জেলায়। আর এ জন্য পুরোনো অ্যাপের পরিবর্তে চালু করা হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন একটি অ্যাপ।
সাদাত জানান, অনেকেই জানে না সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে কীভাবে আইনি সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। আবার যারা আইন প্রয়োগ করেন, তাদের অনেকের কাছে মাদক, যৌন হয়রানির মতো অপরাধগুলো পরিচিত হলেও সাইবার জগতের অপরাধ ও এর ভয়াবহতা সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা নেই। সাইবার অপরাধের শিকার শিশু-কিশোর এবং যারা সুরক্ষা দেবেন, দু'তরফেই সুরক্ষার প্রয়োজন। সে বিবেচনা থেকেই সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নড়াইলের এমপি মাশরাফি বিন মুর্তজা, নড়াইলের ডিসি এবং পুলিশ সুপারের সহযোগিতায় সমন্বিত পদক্ষেপ হিসেবে একটি অ্যাপ চালু করা হয়। একই সঙ্গে একটি ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক পেজ খোলা হয়- যার নাম 'সাইবার টিনস (পুনবৎ-ঃববহং.পড়স)'।
সাদাত জানান, সাইবার টিনসের মাধ্যমে দু'ভাবে সহায়তা দেওয়া হয়। প্রথমত, অনেকের ফেসবুক আইডি কিংবা ই-মেইল আইডি হ্যাক হয়ে যায়, কারও নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে হয়রানি করা হয়। এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তাদের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে ভিকটিমরা সরাসরি আইডি রিকভারি, ফেক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত এবং রিপোর্টের মাধ্যমে বন্ধ করার মতো সহায়তা পায়। আবার যদি কেউ বুলিংয়ের শিকার হয়, কেউ হুমকির শিকার হয়, তাহলে সেটা অ্যাপের মাধ্যমেই পুলিশ সুপারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। তিনি তখন এর প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে পারেন এবং এ ক্ষেত্রে ভিকটিমকে পুলিশের কাছে যেতেও হয় না। পাশাপাশি সাইবার টিনস দল নড়াইলে কভিড-১৯ মহামারি শুরুর পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন স্কুলে নিয়মিত গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষার্থীদের সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে কোন কোন বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে কীভাবে প্রতিকার পেতে হবে- এসব বিষয়ে আলোচনা করেছে। এভাবেই নড়াইলে সাইবার টিনসের কাজ চলেছে। নড়াইলে এখন পর্যন্ত আটজন সাইবার অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। প্রায় ২৫০ কিশোর-কিশোরী সাইবার নিরাপত্তা সমস্যায় সরাসরি সহায়তা পেয়েছে।
এখন আরও বড় পরিসরে কার্যক্রম শুরু হতে চলেছে- এ কথা জানিয়ে সাদাত বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সহায়তায় আগামী নভেম্বর থেকে এই কাজটি সারাদেশে শুরু হবে। এ জন্য এখন প্রথম চালু করা অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন সারাদেশে কার্যক্রম চালুর জন্য নতুন একটি অ্যাপ ডেভেলপ করা হয়েছে, যেটা আগামী নভেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হবে। প্রাথমিকভাবে ১৩ নভেম্বর সারাদেশে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর তারিখ নির্ধারণ করা আছে। ৬৪ জেলায় একসঙ্গে এই নতুন অ্যাপটি লঞ্চ করা হবে।
সাদাত জানান, ২০২০ সালে 'চিলড্রেন পিস' অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর সারাদেশে কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে সাইবার টিনস। তারা শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে বৈঠক করেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় আগামী জানুয়ারি থেকে দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজে নিরাপত্তা ও নিরাপদ ইন্টারনেট কার্যক্রম শুরু হবে। প্রতিটি স্কুল-কলেজে সাইবার টিনস ক্লাব থাকবে। এর মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা কর্মসূচি চলবে।
'চিলড্রেন পিস অ্যাওয়ার্ড' সম্পর্কে সাদাত জানান, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেই তাকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। ২০২০ সালে ৪২টি দেশের ১৪২টি মনোনয়ন জমা পড়ে এ পুরস্কারের জন্য। এরপর 'সাইবার টিনস' শীর্ষ তিনে আসে। শীর্ষ তিনের অন্য দুটি দেশ ছিল আয়ারল্যান্ড ও মেক্সিকো। এরপর চূড়ান্তভাবে 'সাইবার টিনস' নির্বাচিত হয় এবং প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের একজন হিসেবে সাদাত রহমান এই পুরস্কার অর্জন করেন। সে সময়ের অনুভূতির কথা জানিয়ে সাদাত বলেন, এই পুরস্কার পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। বিশেষ করে তার মতো যারা মফস্বল শহরে থাকেন, তাদের কাছে জেলা পর্যায়ে পুরস্কার পাওয়াই অনেক বড় ব্যাপার। তার পক্ষে আন্তর্জাতিক পরিসরে এতবড় পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি একেবারেই কল্পনার বাইরে। তবে এই পুরস্কার সাইবার টিনসের কার্যক্রম সারাদেশে বিস্তৃত করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
সাদাত বলেন, সারাদেশে নিভৃতে তার মতো অনেকেই কাজ করছে। অনেক ভালো কাজ করছে। বড় কাজ করছে। মিডিয়া যদি তাদের খুঁজে বের করে কার্যক্রমগুলো তুলে ধরে, তাহলে এ ধরনের ভালো উদ্যোগের পরিধি এবং অনুপ্রেরণা অনেক বাড়বে।
বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে সাদাত বলেন, সাইবার জগতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কীভাবে ব্যবহার করলে নিরাপদ থাকা যায়, যেমন যে কোনো প্ল্যাটফর্মে অপরিচিত কাউকে বন্ধু করা উচিত নয়, কিংবা কোনো লিংকে ক্লিক করার আগে কী ধরনের সচেতনতা দরকার, সে সম্পর্কে বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের ধারণা খুবই কম। আবার শিশু-কিশোরদের এখনকার বাস্তবতায় অনলাইন ব্যবহার থেকে দূরে রাখাও যাবে না। তাই ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও উদ্যোগ আরও বেশি প্রয়োজন। সাইবার টিনসের কাজকে আরও বিস্তৃত করতে সবার সহযোগিতা চান নিজের মেধা ও কর্মদক্ষতায় দেশের মুখ উজ্জ্বল করা এই কিশোর।